লিখছেন – সৌমী আচার্য্য
কেচ্ছা ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগে না। পাওয়া গিয়েছে অপরাধের চিহ্ন – কুমকুম বোষ্টমীর তেলচিটে অন্তর্বাস আর মহিমবাবুর বাঁ হাতে বাঁধা লাল সুতোর সস্তা তাবিজ।
দুটোই আস্তাকুঁড়ে দেখেছে ললিতবাবু। সান্যালবাড়ির মদ্দা বড় বউ চোখ টেরিয়ে বলেছে, “তা ললিতবাবু, বলি বোস্টমীকে কত ঘনিষ্ঠভাবে চিনতে, এ্যাঁ!” ললিতবাবু অবশ্য আঠার মত দৃষ্টি ছুঁড়েই সটান।
– “ঐ তারেই তো মেলা থাকত বোষ্টমীর ইসে, বেহায়ার মত।”
মণির মা নাক টেনেই চলেছে। পাড়া প্রতিবেশীর সহানুভুতি বিষের মত মনে হচ্ছে। লোকটার মনে এই ছিল?
– “মণির মা, শরীর গেলে কিছুই কি থাকে না? আমার গায়ে শুধুই পচা গন্ধ? তাই তুমি কাছে ঘেঁষো না!”
– “বেহায়া দেখেছি, তোমার মত দেখিনি! এই বয়সে তোমার গায়ের গন্ধ নেব? ঐ হতকুচ্ছিত বোষ্টমীকে দেখে তোমার ফড়ফড়ানি বাড়ে কেন, শরীর যদি গেছেই? রক্ষাকালীর তাবিজ আছে হাতে, কেলেঙ্কারির চেষ্টা কোরো না, মুখে রক্ত উঠে মরবে। তোমার ছোঁকছোঁকানি দেখে তাবিজ বাঁধতে বাধ্য হলাম। আর কেচ্ছা কোরো না বলছি।”
মহিম চুপ করে বাতাবি লেবুতে ভরা গাছটার দিকে তাকায়। পিঁপড়েগুলো গাছটার ভেতরটা কুরে কুরে খাচ্ছে। তা খাক, বয়স হয়েছে যথেষ্ট। চাঁদরাত ভেসে যায়। সংসার আরও দাঁতমুখ বের করে খামচাতে থাকে। শান্তিজল ঝরে না এতটুকু।
– “বলো কী সাঁই, সংসার ছাড়বে কেন? ভরা সংসার তোমার।”
– “আমার আর কিছু দেবার নেই, কুমকুম। অবজ্ঞা ছাড়া কিছু পাওয়ারও নেই।”
– “তাহলে আমার সাথে চলো। আমি কাল মাধুকরীতে বেরোব।”
– “কতদূর! যতদূর গেলে আর ফেরার পথ খুঁজে পাওয়া যায় না, ততদূর?”
– “তুমি চাইলে তাই।”
কুমকুম মুচকি হাসে। শরীর পড়ন্ত বিকেলের আলোর মতো মোলায়েম। মহিম উঠে পড়ে। পুকুরঘাটে জমাট ধোঁয়ার মতো বসে থাকে বোষ্টমী। গুনগুন সুর ভাসে।
‘ভেতর ঘরে ঝড় উঠেছে সাঁই/ ভাঙা হাল ছেঁড়া পাল/ আর কিছু তো নাই/ ভেতর ঘরে ঝড় উঠেছে সাঁই।’
কানে বাজতে থাকে সুর – “ঠাকুর ঠাকুর করলেই কি ঠাকুর মেলে গো? বোস্টম যখন কসাই হয়ে ঘরে লোক ঢোকাল তখন বুঝেছিলাম, শরীরের ওপর একটা খোলস না দিলে লোক চেনা যাবে না সাঁই। সাময়িক শরীর স্নান করার লোক বড় বেশি। আমার দুর্গন্ধ শরীর নোংরার পরতে ম্লান, তবু তুমি জুড়িয়ে যাও কেন? অমন মাথা নীচু করে গান শোনো আর চোখের জল ভাসো?”
– “আচ্ছা কুমকুম, তোমার কেষ্ট ঠাকুরকে তুমি তো দেখো নাই। তাহলে তার জন্য এত প্রেম এত ব্যাকুলতা তোমার কোথা থেকে আসে?”
– “তা যা বলেছ, তবে আমি তো তারে সবার মাঝেই দেখি গো। এই তোমার মাঝেও।”
– “আমি এই আকুল প্রেমটাই খুঁজি গো বোষ্টমী। শরীরের মধ্যে অথচ শরীর ছাপিয়ে যে প্রেম চোখের জলে, উত্তাপ হারিয়েও ঘর বাঁধে, তেমন প্রেম। পাই না কেন গো, সব দিয়েও কেবল নাই নাই আর নাই।”
– “চলো গো সাঁই পথে পথে খুঁজি সেই প্রেম, চলো!
লোকে বলে বলুক মন্দ/ ওরা সব জন্ম অন্ধ/ তুমি আমি আকুল হব/ পথে পথে সঙ্গী হব…চলো সাঁই, বেরিয়ে পড়ি।”
মহিম রক্ষাকালীর তাবিজ ছুঁড়ে দেয় জঞ্জালে, কুমকুমও ফেলে বহু পুরোনো নোংরা অন্তর্বাস। এখন মুখোশ খোলা যায়। এখন গায়ের ময়লা ঘষে চন্দন সুবাসে সাজানো যায়, আহা কী অপার মানুষ এই মহিমবাবু, তাকে পাড়ে না নিলে যে সংসার পাঁকে দম বন্ধ হয়ে মরবে। যাক, কুমকুম তাকে শুদ্ধ করে দিক, আর সেও শুদ্ধ করুক কুমকুমের দুনিয়া দেখার চোখ। ভোরের আলোর আগেই দুটো ছায়ামানুষ পথ হাঁটে। মহিম বলে, “তোমার রূপ সুন্দর গো বোষ্টমী কিন্তু তোমার চোখ আরও গভীর, তোমার গান আরও সুন্দর। তাকে স্পর্শ করে সাধ্য কার?” বোষ্টমী রসকলিতে ডান হাতের তর্জনী ঠেকিয়ে বলে, “কেন গো সাঁই, তোমার।” করতালে বোলে ওঠে।
মণির মাকে পাড়ার মহিলারা গা টিপে জিজ্ঞাসা করে, “হ্যাঁ রে, ঢোঁড়া সাপ ফণা তুলত নাকি? ম্যাগো, বোস্টমীটার ছোট বেলাউজে হাতের তাবিজ যে ভাবে মুখ গুঁজে আছে। তোকে দেখানোর জন্যেই ওভাবে রেখে গেছে বুঝেছিস?”
মণির মার খুব কান্না পায় খুব। কানে বাজে মহিমের কন্ঠ, “ও মণির মা, শরীর না, শরীর না, আমার মন কাঁদে, তোমার কাঁদে না? আমি কি কেবল অভ্যাস তোমার? আর কিছু না?” মণির মা ভেবে পায় না তার কান্নার কারণ ঠিক কী? শরীর, মন, নাকি অভ্যাস?
ভালো লাগল
LikeLike
খুব ভালো লাগলো । চন্ডিদাস ও রজকিনীর প্রেমের অনুকরণে লেখা ।
LikeLiked by 1 person
খুব ভালো লাগলো । চন্ডিদাস ও রজকিনীর প্রেমের অনুপ্রাণিত লেখা ।
LikeLiked by 1 person