ব-য়ে বিরিয়ানি

লিখছেন – অভ্র পাল

এই এপিসোডের অডিও শুনতে পারেন এখানে

মাঝে মাঝে ভাবি, রান্না নিয়ে আবার গল্প হয় নাকি? কিন্তু পালটা উত্তর দিতে গিয়ে মনে হয় গল্প কোথায় নেই? মানুষের অনুভূতিই যখন গল্পের মূল রস, তখন পাঁচটা লেখার মধ্যে একটা অন্ততঃ স্বাদের প্রাপ্য হয় বৈকি। যারা বনফুলের ভোজনরসিক রবীন্দ্রনাথ পড়েননি তারা হয়তো অনুমানই করতে পারবেন হয়তো বাঙালির রসনার অনেক গভীরে মিশে আছে গল্পের ডালপালা। যদিও এই বিষয়ে আমার গুরুদেব সৈয়দ মুজতবা আলিসাহেব। যাক গে, এবার আসি আমার গল্পে।

অনেক বছর আগের কথা। একবার চার বন্ধু মিলে বাইরে খেতে গিয়েছি। শহরের নাম বেলফাস্ট, নর্দার্ন আয়ার্ল্যাণ্ড। সেই সময়ে বেলফাস্টে ভারতীয় রেস্তোরাঁ খুব একটা চোখে পড়ে নি – মানে অন্যান্য ভারতীয় অধ্যূষিত শহরের বাঙালির পক্ষে কল্পনা করাও কঠিন যে শহর জুড়ে মোটে একটা ভারতীয় রেস্তোরাঁ। আমরা স্কটল্যান্ডে পাহাড়ে ওঠার পথেও বাংলাদেশি খাবার পেয়েছি – সেখানে ওয়েটার পাক্কা সিলেটি উচ্চারণে আমাদের জিজ্ঞেস করেছে – সিকেন টিক্কা ভূনা না সিকেন টিক্কা মশালা। সে তুলনায় বেলফাস্টের দিনগুলো ছিল প্রায় চাতক পাখির মত। দেশের বাইরে থাকার কল্যানে, মনের মধ্যে কোনও এক কোনে জমে থাকা সুক্ষ্ম ভারতীয় আবেগগুলো একবার সুজোগ পেলেই সুড়সুড়িয়ে উঠত। আমারও উঠল, মুখ ফসকে বলেই ফেললাম, ‘জানিস, এক কালে আমি খুব বিরিয়ানি রাঁধতে পারতাম।’

এখন এরকম একটা নিরীহ কমেন্ট যে অফস্ট্যাম্পের বাইরের শর্টপিচ বলের মত হয়ে দাঁড়াতে পারে, সেদিকে খেয়াল ছিল না। আমার কথা শুনে, সৌমিক অম্লানবদনে বললে, ‘সে তো আমিও কলেজে ছ’ফুট লম্বা ছিলাম’। পঙ্কজ তো আরেক কাঠি বাড়া, সে বললে, ‘আমি তো কলেজে থাকতে রঞ্জি খেলতাম’। সৌমিক বরাবর বিষাক্ত – কুল্লে সাড়ে পাঁচের কম হাইট নিয়ে এরকম তুরীয় প্যাঁক, যে কেউ মারতে পারে না। পঙ্কজের খেলার ব্যাপারটা না হয় ছেড়েই দিলাম – হওয়ার মধ্যে যেটা হল সেটা হচ্ছে এই যে আমার বিরিয়ানি করার গ্যাসবেলুনটা নিমেষের মধ্যে চুপসে গেল।

এখন কথাটা যে নেহাত মিথ্যে বলেছিলাম তা কিন্তু নয়। বিরিয়ানি বানাতে শেখা হস্টেলে থাকতে। তাও আবার প্রেশার কুকারে, কেরোসিন স্টোভের ওপর। মা’র কাছে শিখেছিলাম যে মাংস কষে তার ওপর চাল দিয়ে দুটো সিটি মারার চেয়ে সহজ উপায়ে বিরিয়ানি আর হয় না। সে কথা একদিক থেকে ঠিকই – প্রেশারকুকার নেই এমন রাধুনি কি আর দুনিয়ায় আছে? সেই সময়ে হোস্টেলের ক্যান্টিনের অবস্থা কেমন ছিল একটা উদাহরণ দিলেই পরিষ্কার হবে। ধরুন সোমবার দুপুরে হয়েছে রাজমা আর রাতে হয়েছে কালি ডাল (খোষা সুদ্ধ বিউলির ডাল)। তো মঙ্গলবার দুপুরে আগের দুবেলার অবশিষ্ট ডাল মিশিয়ে ঢেলে দেওয়া হত পাতে। এহেন পরিস্থিতিতে আমার সেদ্ধ বিরিয়ানি যে সুপার ডুপার হিট ছিল, তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু সৌমিকের কাছে প্যাঁক খেয়ে বুঝলাম আবার নতুন করে মাঠে নামতে হবে।

যাই হোক, এর পর যমুনায় অনেক জল বয়ে গেছে। চুল পাকতে পাকতে বুঝতে পারলাম বিরিয়ানিটা আদপে বিরিঞ্চবাবার মত কেস – সূর্যবিজ্ঞান আয়ত্ত না করা গেলে কালস্তম্ভ করা যায় না। অর্থাৎ গোটা ব্যাপারটাই একটা সুক্ষ ব্যালেন্সের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কিরকম? এক্কেবারে ডিফারেন্সিয়াল ইকুয়েশনের মত ব্যাপার। মাংস গলছে একটু একটু করে, আর চাল বাড়ছে ভাতের দিকে। সবে মিলে মাংস থেকে ঠিক ততটাই জল বেরোতে হবে, যা কিনা চালটাকে এক্কেবারে ঝুরঝুরে সেদ্ধ করতে পারে। এটিই বিরিয়ানির একমাত্র ক্যাচ। এইটা রপ্ত করতে হলে একটাই উপায় দুপুর রোদে সূর্যের দিকে চেয়ে ঠিক একশ বার বলতে হবে মার্তণ্ড, মার্তণ্ড, মার্তণ্ড,মার্তণ্ড – একবার জিভ জড়িয়ে গেল কি গলা শুকিয়ে গেল তো ব্যস, সাত দুকুনে চোদ্দর চার আর হাতে রইল পেন্সিল, হওয়ার কথা ছিল বিরিয়ানি – হয়ে গেল ভাতেভাত।

তাহলে উপায়? লখনৌই হেঁসেল তো আর সব্বার নয় যে ঘিয়ের প্রদীপের কবোষ্ণতায় মাটির হাঁড়িতে বিরিয়ানি বসবে। আছে আছে – একটা দুটো নয়, একশ আটটা উপায় বেরোতে পারে, আপনি যদি অঙ্কটা এতক্ষণে ধরে ফেলে থাকেন। তখন আপনি প্রেশার কুকার কেন, ডেচকি, রাইস কুকার, এয়ার ফ্রায়ার, স্টিমার মায় গ্রিলে অবধি বিরিয়ানি করে ফেলতে পারেন। এর মধ্যে কদিন আগে একটা রেসিপির কথা শুনলাম – তার নাম চিকেন মান্ডি। সেটা সাধারণত আরব দেশের রান্না। প্রথমে একটা পাত্রে চাল ভিজিয়ে, ম্যারিনেট করা মাংস একটা স্ট্যান্ড ওয়ালা তারজালির ওপর বসান হয়। এই স্ট্যান্ড থাকে চালের মধ্যে – ফলে অল্প আঁচে মাংস পুড়তে থাকে, তার জল নামে ভাতের ওপর আর ভাত রান্না হতে থাকে অল্প অল্প করে। বেশ মজা পেলাম – একটু বেশি পরিমাণ বিরিয়ানি করতে এই উপায়টা বেশ কাজে লাগে। কাচ্চি বিরিয়ানির নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই। সেখানে মাংসটা আর আলাদা করে রান্না করা হয় না। একটু বেশিক্ষণ ম্যারিনেট করে নিয়ে ভেজা চালের সাথে কয়েক লেয়ারে মিশিয়ে দমে বসিয়ে দেওয়া হয়। শুধু তাই না – ওপরে, নীচে, দু জায়গাতেই ভাপ দিতে হবে খুব কম আঁচে। আসলে বিরিয়ানি করতে গেলে কোন রেসিপি ধরে চললে হবে না – হাত পুড়িয়ে কয়েকবার ভাতেভাত করতে হবেই।

গল্পটা বিরিয়ানি নিয়ে শুরু করেছিলাম বটে – কিন্তু আসল ব্যাপারটা হল, এত হাত পুড়িয়ে এই জায়গায় আসা – এখন ফিরে তাকালে মনে হয়, গোটা স্মৃতিটাই আসলে একটা গন্ধ; আর সে গন্ধ ধোঁয়া ওঠা বিরিয়ানির হালকা গোলাপজল আর মিঠা আতরের মতই মিষ্টি।


মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

Blog at WordPress.com.

Up ↑

%d bloggers like this: