নন্দিনী অধিকারী
“ও শর্মাভাবী,ও মিশ্রভাবী,সঙ্গীতা তোমরা সক্বাল সক্কাল কোথায় চললে গো দলবেঁধে? সেজেগুজে?”
“আজ আমাদের আমলা নবমী ব্রত যে।”
” সে আবার কি?আগে তো কখনো শুনিনি”।
“চলো আমাদের সঙ্গে। দেখবে।”
“কোথায় যাচ্ছ,সেটা তো বলবে” ।
“ঐযে মন্দিরের লাগোয়া জমিতে আমলকী গাছ আছে না,ঐখানে।
নাহ,ধো’কে আনা লেকিন। নতুন চুড়ি পরে।কাচা কাপড়ে।”
“নতুন চুড়ি কোথায় পাব গো?”
“ওমা!নেই? কাঁচ কি চুড়িয়াঁ?
” না গো”
“ঠিক আছে,এসো। আমরা পরিয়ে দেব”।
আনন্দী দৌড়তে দৌড়তে স্নানে গেল। যবে থেকে স্বামীর সঙ্গে বাংলার বাইরে এসে সংসার পেতেছে,তবে থেকেই তার,”অচেনাকে চিনে চিনে উঠছে জীবন ভরে”।
তাদের কলোনীতে সত্যিই সত্যিই বারোমাসে তেরো পার্বণের ঘনঘটা। দুবে সাহেবের বাড়িতে প্রতিবছর হোলিতে মালপো দিয়ে তারা এঁচোড়ের কালিয়া খেয়ে আসে। হায়দ্রাবাদের গায়ত্রীর বাড়িতে বরলক্ষ্মীপুজোর প্রসাদে পায় খাট্টাচাওল বা ইমলি রাইস। ছটপুজোর ঠেকুয়া যতদিন থাকে,আনন্দীর চায়ের সঙ্গে বিস্কুট লাগেনা। মারাঠি মেয়ে অনীতার ডাকে মকর সংক্রান্তির হলদিকুঙ্কুমে গিফট প্রাপ্তি হয়। সৈয়দ সাহেবের ইফতার পার্টিতে সপরিবারে তাদের নেমন্তন্ন। আনন্দী মিশুকে বলে সর্বত্র তার ডাক পড়ে। সে এইসব অচেনা রীতিরেওয়াজ, খাওয়াদাওয়া খুঁটিয়ে লক্ষ্য করে। সবেতেই তার বড় আগ্রহ। নানারকম প্রশ্ন করে । সব প্রশ্নের উত্তর সবসময় অবশ্য মনোমত হয় না।
এই তো গরমকালে তার বাড়ির সামনে মস্ত বটগাছটার তলায় সেদিন শা়ঁখের আওয়াজ। ঘন্টাধ্বনি। জানলা দিয়ে দেখে ত্রিপাঠি ভাবী আর তার পুত্রবধূ চুলে বটপাতা গুঁজে বটগাছ তলায় পুজো করছে। শাশুড়িবৌ দুজনকেই বেশ বনদেবীর মত দেখাচ্ছে। ভাবীর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ইশারায় ডাকল। বটগাছকে আরতি করে ,সুতো বেঁধে, হাতপাখার বাতাস করা হল। তারপর বটগাছের ছায়ায় বসেই প্রসাদ খাওয়া। বটসাবিত্রীর ব্রতকথাও শোনা হল।
দীর্ঘায়ু বটগাছ যুগযুগ ধরে কত সাবিত্রীর দুঃখের গল্প শুনে আসছে!
সাক্ষী হয়ে রয়েছে কত ঘটনার।
আনন্দীর ঝি’মা মানে ঠাম্মীর মায়ের ছেলে ছিলনা। ঠাম্মী একমাত্র সন্তান। তাই তাঁরা স্বামী-স্ত্রী গঙ্গার ধারে একটি শিশু বটগাছ পুঁতে ছিলেন। তাঁদের মনে হয়েছিল বিবাহিত মেয়ের গোত্রান্তর হয়ে যায়।তার করা শ্রাদ্ধে তাঁদের মুক্তি হবে না।
পুরোহিতের বিধানে এই অক্ষয়বট নাকি পুত্রসন্তান হয়ে স্বর্গে সাক্ষী দেবে ।বেশ ঘটা করে, পুরোহিত পুজো করলেন।তারপর বটবৃক্ষের প্রতিষ্ঠা হল। ছাগল-গরু যাতে তার সদ্ব্যবহার না করে সেজন্যে বেড়া দেওয়া হয়েছিল।
সে গল্প আনন্দী শুনেছে। ইউনিভার্সিটিতে পড়া আনন্দীর ভাবনায় তখন প্রখর নারীবাদ ।সে তর্ক করেছিল ঝি’মার সঙ্গে। কেন, ছেলে নেইতো কি হয়েছে? তা’বলে তোমাকে ঘটা করে বটগাছ পুঁততে হবে!যত্তসব !
ঝি’মা বলেছিল,”তোমরা কলেজে পড়া মেয়েরা ওসব বুঝবে না মা। যখন বয়স ছিল তখন পালাপার্বণে প্রায়ই গঙ্গাচানে যেতুম। ঐ বটগাছের গোড়াটা পরিষ্কার করে দিতাম। জল ঢালতাম। শুকনো পাতা ফেলে দিতাম। নিজে হাতে পোঁতা একটু একটু করে বড় হয়ে ওঠা গাছটাকে সন্তান স্নেহে দেখতাম। কি যে আনন্দ হত!”
আজ সে কথা বোঝে আনন্দী। কলেজ হোস্টেলে থাকে তার একমাত্র সন্তান রাকা। তার অদর্শনে সে গাছপালাকেই আঁকড়ে ধরেছে। আনন্দীর বাংলোর বাগানে হরেক রকম ফুলগাছ তার সন্তান স্নেহে,যত্নে বেড়ে উঠছে। ফুল ফুটছে। কোন গাছের একটু বেশি জল লাগে। কারোর ধূপছায়া চাই। মঞ্জরিত গাছের একটু বেশি খাবারদাবার দরকার গর্ভবতী মায়েদের মত। কষ্ট না দিলে ফুল দেয় না বুগনভেলিয়া,মধুমালতী। তাই তাদের জল কম দিতে হয়। সবটাই তার নখদর্পণে।
তার বাগানের এক পাশে বিশাল হরতুকী গাছ। সেখানে কত টিয়াপাখি বসে। তারা ফলটি খেয়ে বীজ ফেলে দেয়। পথচলতি মানুষ হরতুকী কুড়িয়ে নিয়ে যায় । হজমের ওষুধ তৈরি করে।
বসন্তের রাতে শালগাছের মঞ্জরীর সুগন্ধ বাতাস ভারী করে দেয়। তখন সে রবিঠাকুরের কবিতার মর্ম অনুভব করতে পারে,
“পূর্ণিমা-রাতে পুষ্পিত শালের মঞ্জরী যত/
কী যেন শুনিতে চাহে ব্যগ্রতায় করি শির নত।”
কি শুনতে চায় সে? আনন্দীর গতজন্মের প্রণয়কথা! নাকি এজন্মেই তার ডাকঘরের সুধা হবার খুশি। ছোটবেলায় সুধাসাজার কথা এখনো ভোলেনি আনন্দী।তাই সুধা মালিনী আর অমলের গল্প শোনে শালের মঞ্জরী। গাছপালার সঙ্গে থাকতে থাকতে এমন নিবিড় করে তাদের ভালোবাসতে শিখেছে আনন্দী । বুঝতে শিখেছে তাদের কথা।অনুভূতি। প্রকৃতির পাঠশালায় আনন্দীর নিত্যনতুন জ্ঞানার্জন।
তবে আর ভাবের ঘরে থাকলে তার চলবে না।দেরী হয়ে যাবে। আনন্দী আলমারি খুলে একটা হলুদ রঙের শাড়ি বা’র করে পরল। এরা পুজোপার্বণে লাল, হলুদ শাড়ি পরা পছন্দ করে। সঙ্গে ষোলহ শৃঙ্গার। আনন্দী অবশ্য সেদিকে বিশেষ গেল না।
মন্দির পেরিয়ে আমলকী তলায় গিয়ে দেখে সেখানে যেন একঝাঁক লালহলুদকমলা পাখিদের কিচিরমিচির।আনন্দী সেখানে পৌঁছতেই মনীষা তাকে দুহাতে কাঁচের চুড়ি পরালো ।মন্ত্রপাঠ হল। ঘন্টা বাজিয়ে আরতিও। একটুকরো আমলকী মুখে দিয়ে ব্রতীরা ব্রতকথা শুনতে লাগল……….
“আজ কার্তিকমাস। শুক্লপক্ষ। নবমী তিথি। আজকের দিনে আমলকী গাছ,যা প্রাচীনকাল থেকেই এক মহান ওষধি বলে পরিচিত,তার পুজো করা হয়। এ পুজো করলে রোগবালাই দূর হয়। স্বয়ং নারায়ণ প্রসন্ন হ’ন।
প্রাচীনকালে এক রাজা ছিলেন। তিনি প্রতিদিন সকালে বেশ কিছু আমলকী ফল প্রজাদের দান করে তবেই জলগ্রহণ করতেন। তাঁর রাজ্য জুড়ে আমলকী গাছের বন। আমলকীর ঔষধি গুণে সে রাজ্যের প্রজাদের অসুখবিসুখ নেই বললেই চলে। আমলকীর গুণে সবাই স্বাস্থ্যোজ্জ্বল। টগবগে। তিনি বিশ্বাস করতেন, আমলকী গাছে নাকি স্বয়ং নারায়ণের বাস। তাই প্রতি বছর আজকের দিনে আমলকী গাছের পুজোর প্রচলন করেন তিনি।
ওমা, আমলকী গাছেও নাকি ভগবান বিষ্ণুর বাস! লালহলুদ উজ্জ্বল রঙের শাড়ি পরে কলকল করতে করতে মেয়েরা আমলকী গাছকে পরিক্রমা করল। হলুদ সুতোয় বেঁধে তাকে আপন করে নিল। আনন্দীর তাই বুঝি মনে হচ্ছিল রাসলীলা চলছে নব বৃন্দাবনে! স্বয়ং রাসেশ্বরকে মধ্যমণি করে সখিরা প্রদক্ষিণ করছেন।
গাছ যে কখন এভাবেই ঈশ্বরের প্রতিরূপ হয়ে যায়! সেই আবার সন্তান হয়ে সাক্ষী দেয় স্বর্গে ! তথাগত বুদ্ধের তপোপ্রভায় অশ্বত্থগাছ বোধিবৃক্ষের মর্যাদা পায়। বিরহিনী রাধারাণী তমালগাছকেই কৃষ্ণ ভেবে আলিঙ্গন করে কাঁদেন! কদম গাছের ডালে চিরকালের মতো প্রেমের দোলনা বাঁধা হয়ে যায়।
আজন্ম কাল ধরে এই বিশ্বাস নিয়েই আমরা বৃক্ষদেবতার সেবা করেছি। তুলসীকে ঘরের মেয়ে করে তার বিয়ে দিয়েছি কার্তিকের অনন্ত একাদশীতে। দুর্গাপুজোয় নবপত্রিকার পুজো করেছি মৃন্ময়ী প্রতিমার সঙ্গে।ঋষিরা অশ্বত্থগাছকে বন্দনা করে মন্ত্রোচ্চারণ করেছেন,
“আয়ুঃ প্রজাং ধনং ধানং সৌভাগ্যং সর্বসম্পদং/দেহি দেবা মহাবৃক্ষ ত্বামহং শরণং গতঃ”।
একালের কবি রবীন্দ্রনাথ গাইতে শিখিয়েছেন,
“ধূলিরে ধন্য করো করুণার পুণ্যে,হে কোমল প্রাণ/মরুবিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে হে প্রবল প্রাণ”।
আনন্দী মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে এবার বাড়ি গেলে একবার গঙ্গার ঘাটে যাবেই। সে ঠিক চিনে নিতে পারবে ঝি’মার পোঁতা সেই বটগাছটিকে। এতদিনে সে নিশ্চয়ই তার ডালপালা মেলে অনেক বড় হয়ে গেছে। তার কোটরে কোটরে, ডালে ডালে গড়ে উঠেছে কত সংসার! সেখানেও নিত্য ভাঙাগড়ার খেলা। তার চোখের সামনে গঙ্গার স্রোতে ভেসে গেছে কত মানুষের সুখ-দুঃখ-চোখের জল। সে সব কিছুর সাক্ষী। সে কত কিছু জানে!
আনন্দী কিছুটা সময় তার ছায়ায় বসবে। ঝি’মার মতই সে গাছের গোড়া পরিস্কার করে দেবে। সেখানে যে তার ঝি’মার স্পর্শ লেগে আছে। নত হয়ে প্রণাম করবে সে অক্ষয় বটকে। তারপর গল্প করবে। আনন্দীর মনের প্রাণের অনেক কথা যে তাকে বলার আছে….. …….
মন্তব্য করুন