হিসাবের বাইরে

প্রতিমা রায়

সকালে আশাটা ছিল বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আশায় জল ঢেলে আশঙ্কাটাই শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়ে গেল না, আজকেও না, এই নিয়ে পাঁচদিন

অপরূপা যতবার ফোন করে, একই কথা মন্ত্রের মত উচ্চারিত হয় – “দ্য নম্বর ইজ সুইচ অফ।”

সময়কে গন্ডীতে বেঁধে রাখা সম্ভব নয় অগত্যা স্ক্রাবারটা সাবানে চুবিয়ে বেসিনের কলটা খুলে সিঙ্ক থেকে একটা একটা বাসন তোলে মাজার জন্য হাতটা ঘোরাতে ঘোরাতে ভাবে যে কালকে আসবে নিশ্চয়, নাহলে পরের দিন, তবে সে না আসার কারণ জানতে চাইবে না কেননা সুন্দর করে গুছিয়ে এমন জবরদস্ত বলবে, যাতে কিছু বলার থাকবে না মিথ্যে বলতে এরা অভ্যস্ত হয়ত হাসতে হাসতে বলবে গিন্নিমা, শরীলটা ভাল ছিল না গো বা “বর মালমূল খেয়ে এসে এমনভাবে গায়ে হাত তুলেছে সারা শরীলে ব্যথায় উঠতে পারলুম না নয়ত কোনো বিপদ আপদ বা আরও বড় কোনো অজুহাত খাড়া করবে, যাতে করে মাসে চার পাঁচদিন বা তার বেশি ছুটি অবধারিত

উঃ, আর পারি না অপরূপা ঝুঁকে বাসন টা তুলতে গিয়ে টের পায় কোমরে জোর কমেছে, পায়ের লিগামেন্টে বেশ ব্যথা তবে তার চেয়েও এখন বড় ব্যথা বোধহয় – মাধবী গত সপ্তাহেই মেয়েটা অতগুলো টাকা ধার নিয়েছে, আর এই সপ্তাহে প্রথমদিন থেকেই গায়েব! অতগুলো টাকা ধার দেওয়া মোটে ঠিক হয়নি, আসলে আগের মেয়েটা কাজ ছেড়ে দিতেই যাতে এ টেঁকে তাই তখন মাথায় আসেনি মেয়েটা যদি আর না আসে বা ঠকায়! আজকাল তো একা থাকা বয়স্ক মানুষেরা টার্গেট হয়ে যায় অনেক সময়

অপরূপার মনের একটা অংশ যুক্তি সাজাতে থাকে মাধবীকে একটু অন্যরকমই তো মনে হত ওর শ্যাওলা ঢলঢলে পানপাতার মতো মুখভারি মিষ্টতার সঙ্গে কোথাও যেন এক সাগর দুঃখ টলটল করে চোখের নীচে কালো ছায়ার ভেতর দীঘির জলের মত মায়া অপরূপার তো যত্নও করত মেয়েটা অন্য মনটা সায় দেয় – “এই মায়া ময়তা মেয়েটার বর্ম হয়ত নিজের উপর নিজেরই এবার রাগ হয় ভাল করে খোঁজ খবর না নিয়ে…. আজকাল বড় বেহিসেবি আর অবিবেচক হয়ে উঠছে অপরূপা সে কি বয়েসের কারণে! অন্য মনটা বলে চলে এতকাল ব্যাঙ্কে চাকরি করে একা হাতেই সংসার সামলেছ, সময় বা অর্থ কোনোটারই অপচয় হতে দাওনি, বাবুয়া চাকরি পেয়ে হায়দ্রাবাদে ফ্যামিলি নিয়ে সেটেল হলে হাঁপ ছেড়েছিলে, একমাত্র সন্তানকে মানুষ করতে পেরে তারপর রিটায়ারমেন্ট, কর্তার চলে যাওয়া, সব তো পার্ট অফ লাইফ তবে কি আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরেছে?”

বাসন টা র‍্যাকে গুছিয়ে রাখতে রাখতে বুঝতে পারে কোমরে ব্যথাটা টনটন করছে ওষুধগুলো স্বপনকে সঙ্গে করে আজ কিনে নিয়ে আসতেই হবে

 

বিকেলে তামাটে সূর্যের ছায়া লম্বা হওয়ার আগেই স্বপন রিক্সা নিয়ে আসে পাশেই বহুদিন ধরে স্বপন ভাড়া থাকে, আগে বউ ছিল এখন একা তবে সারাদিন খুব পরিশ্রম করেরেললাইনে ঝুপড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলে, স্বপন সংসার নিয়ে পথে বসে, তখন অপরূপাই ওদের এই পাড়ায় নিয়ে আসে এতদিন অপরূপাকে রিক্সা করে ঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছৈ দেওয়া নিয়ে আসা স্বপনই করেছেঅপরূপার দরকার হতেই গায়ে গেঞ্জিখানা ঝুলিয়ে পায়ের ছাপ পড়া চপ্পলটা পরে রিক্সাটা সামনে এনে বলে – কোথায় যেতে হবে গিন্নিমা?”

মোড় মাথার ওষুধের দোকান চিনিস?”

হ্যাঁ,” মাথা নাড়ে স্বপন

তবে চল তাড়াতাড়িদোকানের কথায় অপরূপার ভেতর আবার মাধবীর কথাটা চাগড় দিয়ে ওঠে কথায় কথায় মাধবী বলেছিল এখানে ও কাজ করে

না, মাধবী এ কদিন এখানেও কাজে আসেনি দোকান থেকে মুখ বাড়িয়ে ভদ্রলোক জানালেন – “মাধবী আমার  মায়ের দেখাশোনা করে খুবই কর্মঠ এবং বিশ্বস্ত তবে এ কদিন না আসার কারণ জানা নেই খালপাড়ের সামনেই পাশে ভাড়াবাড়িতে থাকে

অপরূপা আজ অন্য মনের কথা শুনে চলেছে কী ভেবে বললে – “চল স্বপন খালপাড়ের রাস্তায়

কিন্তু গিন্নিমা!”

কোনো কিন্তু না

স্বপন গিন্নিমাকে চেনে, আর কথা বাড়ায় না রিকশা চলতে থাকে

আঁকাবাঁকা কালো পিচের রাস্তা পুরানো জীর্ণ চেহারা নিয়ে এগিয়ে গেছে খাল পাড়ের দিকে মাঝে মাঝে রাস্তার দুপাশে পাহারাদার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাঢ় সবুজ মাথার গাছগাছালি, দু এক জায়গায় ড্রেনের জমা জল আর রাস্তার নোংরা হাত ধরাধরি করে হেঁটে গেছে বহুদূর, তার থেকে পূতিগন্ধ গুলিয়ে বাতাসের বুক ভারী, নাকে কাপড় দেওয়া ছাড়া উপায় নেই মিনিট পাঁচেক আরো এগিয়ে খুঁজে পায় লাল টালির ছাউনি দেওয়া একচালা ঘরখানা ঘরের কালো কাঠের দরজার সামনে প্রাহীন উবড়খাবড় ইঁটের দেয়ালকে অবলম্বন করে উঠেছে একখানা হৃষ্টপুষ্ট লাউয়ের চারা জড়কে অবলম্বন করে বেড়ে ওঠা চারাটা বেশ হাওয়ায় দোল খাচ্ছে

ক্যাঁচশব্দ করে রিকশটা থামায় স্বপনআপনি রিকশাতেই বসুন গিন্নিমা, হিসেবমত বোধহয় এ ঘরটাই আমি দেখে আসছি

ঠকঠকদরজায় আওয়াজ করতেই ভেতর থেকে সাড়া আসে কে?”

দরজা ঠেলে বেরিয়ে এসে অপরূপাদের দেখেই চমকে ওঠে মাধবী বলে আপনারা?”

জড়তাটুকু কাটিয়েই এবার বলে ওঠে ভেতরে আসেন গিন্নিমা আপনি নিজে এসেছেন এতখানি!

তুই একটা খবর দিলে কি আমাকে এতদূর এই শরীরে ছুটে আসতে হয়? ভাবলাম শরীর খারাপ হল নাকি, তাই এলাম তা যাসনে কেন?”

নাইটির উপর জড়ানো ওড়নাটা আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে মুখখানা নীচু করে বলে – “একটা অনুরোধ করি গিন্নিমা – এতদূর যখন এলেন একবার ভেতরে আসেনসত্যিই আমার খারাপ লাগছে, কিন্তু বললে হয়ত আপনার বিশ্বাস হবে না

না, আজ সময় নেই

চলেন না গিন্নিমা

অন্য মনের কথায় অপরূপা মাধবীর সঙ্গে চলে ভেতরে, পিছনে স্বপন স্যাঁতসেঁতে মেঝে ড্যাম্প লাগা যত্রতত্র দেয়াল পেরিয়ে প্রায় গুহার মত ঘুপচি বারান্দা পায়ে পায়ে পেরোতেই ধূপের গন্ধ নাকে এসে লাগে সেই গন্ধের দিকেই যেন ওরা এগোচ্ছে যত এগোতে থাকে গন্ধ তত তীব্র হয় তারপর পৌঁছায় মন্দিরের মত ঝকঝকে নিকানো এক চিলতে শোয়ার ঘরটাতে, তার একদিকে ছোট চারপায়া, আরেকপাশে ঠাকুর দেবতা রাখা সেখানে মাধবী পুজো করেছে, সেখান থেকেই ধূপের গন্ধ আসছে

এই আমার ঘর গিন্নিমাএই আমার সংসার এই ভাই এদিকে দেখ

এতক্ষণে অপরূপা খেয়াল করে খাটে শুয়ে বছর ছয় সাত বয়সের বাচ্চার শরীরের মত একটা শরীর মুখে গোঁফ দাড়ি সে শীর্ণ হাতখানা উপরে তুলে কপালে ঠেকিয়ে মাধবীর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট দুটো ফাঁক করে হাসতে থাকে কী মায়াময় সে হাসি!

গিন্নিমা, আমার পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী ভাই

অপরূপা চমকে ওঠে

বিরল রোগ নিয়েই জন্মায় পৃথিবীতেআমার বাবা মায়ের সে রোগের চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য ছিল না বয়স যত বাড়ে, রোগ তত বাড়ে, কমে ওর শরীরের বৃদ্ধি একসময় প্যারালাইজড হয়ে বিছানাই হয়ে ওঠে ওর পৃথিবী বাবা মার মৃত্যুর পর বাবা মায়ের রেখে যাওয়া যেটুকু যা ছিল, তা ভাগ করে নিয়ে অন্য ভাইবোনেরা সেটেল হয়ে গেল শুধু ভাগ হল না এই ভাইঘর থেকে বের করে ওর ঠাঁই হলো উঠোনে দড়ির খাটে, ফেলে রাখা জিনিসপত্রের ভেতর ঠা ঠা রোদ্দুরে জলের জন্য ককিয়ে উঠল ওর প্রাণটা ও আওয়াজ করে উঠলকেউ দেখল না, ফিরে তাকাল না আমি কাছে গেলাম বুঝলাম ওর ঐ জড় মাংসপিণ্ডের মত শরীরটা আসলে একটা মানুষের জীবন মৃত্যুর মাঝখানে ঝুলে থাকা একটা অসহায় প্রাণে তারপর থেকে ভাই আমার কাছে,”- কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে থামে মাধবী  

অপরূপা মাধবীর মুখের দিকে চেয়ে থাকে

মাধবী বলে – “গিন্নিমা!”

তোর বর বাচ্চা?”

হাসে মাধবী – “নেই বিয়ে করিনি এক একসময় মনে হত ওর দায়িত্ব আর পারছি না নিতে, ও চলে গেলেই বাঁচি আমার বয়সী মেয়েরা বিয়ে করে সংসার করছে তবে আমি কেন এভাবে মরব? কতবার ছেড়ে পালাতে চেয়েছি, পালিয়েওছি তারপরইদিদিএকটা ডাক পিছু পিছু ধাওয়া করেছে পারিনি, ফিরে এসেছি।“

অপরূপার মনের একটা অংশ ফিসফিসিয়ে বলে – “মাধু!তখনই হো হো হাসির শব্দ

দুজনেই পিছু ফেরে দেখেওদের কথা শুনে মাধবীর ভাই হাসছে

মাধবী ভাইয়ের গায়ে চাদরটা টেনে দিয়ে বলে – “একটু ঘুমো ভাই তারপর অপরূপার দিকে ফিরে বলে -“জানেন গিন্নিমা, বাড়ি ফিরে ওকে শোনাই আমার সারাদিনের গল্প ও শোনে, আর বাইরের পৃথিবীকে অনুভব করে, খুশি হয় কখনও শুনে হা হা করে হাসে আমিও হাসি, কষ্টের হলে চুপ করে যায়, আমিও চুপ থাকি তখন ও বলে কাল তোর ভাল হবে দি, দেখিস আমি বলি বলছিস তাই যেন হয়! বাঁচার তো কোনো নির্দিষ্ট ছক হয় না গিন্নিমা ভাল থাকাটা একজনের কাছে এক একরকম”    

অপরূপার মুখে কথা আসে না হাসি ছড়িয়ে ছেলেটা বলার চেষ্টা করে দি,

মাধবী অপরূপার পায়ের কাছে এসে বসে পড়ে বলে – “ওর শরীরটা খুব খারাপ হয়েছিল গিন্নিমা তাই এক্সট্রা কাজ হিসেবে জলদি আপনার কাজটা নিই আপনি টাকাগুলো ধার দিয়ে খুব উপকার করেছেন এ যাত্রায় ওকে বাঁচাতে পারলাম আমি ঋণী হয়ে রইলাম ফোনে পয়সা ছিল না মাফ করবেন গিন্নিমা কালই যেতাম কাজে।”

অপরূপার চোখের কোণে বালির মতো জল চিকচিক করে মাথা নাড়ে,যাস তাহলে কাল।”

ধ্যাড়ধ্যাড়ে রাস্তায় টাল খেয়ে এগোতে থাকে স্বপনের রিক্সা রিকশার চাকা যত ঘুরতে থাকে তত ছোট হয়ে যেতে থাকে খালপাড়ের রাস্তা, টালি মাথায় একখানা বসে যাওয়া ঝুপড়ি ঘর, রোগাটে একটা মুখ বড় হয়ে ওঠে একটা ঝকঝকে হাইরোড, দুপাশ বাঁধানো রাস্তার মাঝখান জুড়ে বসানো লাল হলুদ সেপারেশন খাম্বা তার উপর দাঁড়িয়ে বাবুয়া, বাবুয়ার ছেলে মেহুক নাতি মেহুকের টানে কতবার কলকাতা থেকে হায়দ্রাবাদ ছুটে গেছে অপরূপা মেহুক বড় হতে থাকে অপরূপার খুশি ধরে না তখনই বৌমা শিনা বলে – “পাঁচতলার এই ফ্ল্যাটটাতে জায়গা ভীষণ কম, মা জিনিসপত্র ঠাসাঠাসি তার উপর মেহুকটাও বড় হয়ে উঠছে আপনি বরং দোতলায় একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নেন, যখন আসবেন, থাকবেন।”

অপরূপার চোখের সামনেটা দুলে উঠেছিল স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিল ফ্ল্যাটের পাাঁচতলা থেকে দোতলার সিঁড়িগুলোর দূরত্ব কলকাতা থেকে হায়দ্রাবাদের দূরত্বের চেয়েও বেশি, এ দূরত্ব রোজ সে কীভাবে অতিক্রম করবে? আর হায়দ্রাবাদ যাওয়া হয় না সে তো কতদিনের কথা মনে পড়তেই অস্ফুটে ডাকে – “বাবুয়াকোথা কী! বরং এই চওড়া রোডটা যে মিলিয়ে যাচ্ছেকোথায়?”

ঝাপসা দেখছে কি সবকিছু হাত তুলে দেখে চোখে চশমাটা তো আছে তবে! স্পষ্ট দেখে হাইরোডটা মিশে যাচ্ছে খালপাড়ের এই সরু রাস্তাটার সঙ্গে রাস্তা দুটোর সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে দুই নারী মাধবী! আর একজন যে অবিকল তার মত দেখতে মাধবীর ভাইয়ের জায়গায় কে! বাবুয়া! না, না এ হতে পারে না একটা সুন্দর হাওয়া ঢুকে রিক্সার ভেতর লুটোপুটি খায়, অন্য মন বলে মাধবীর ভাইয়ের মত আজ শুধু বাবুয়ার অস্তিত্বটুকুই তো তোমার কাছে আছে অপরূপা কী করে অস্বীকার করবে তুমি!”

গেটের সামনে রিক্সাটা রেখে পেছনে মোড়ে স্বপন দেখে গিন্নিমার চোখ বন্ধ, হাতটা কেমন যেন ছেড়ে দিয়েছে চিৎকার করে স্বপন গিন্নিমা! গিন্নিমা!”

হাসপাতালে পরের দিন চোখ খোলে অপরূপা মাথার পাশে বসে মাধবী পাশে স্বপন ধীরে ধীরে চুলে বিলি কাটছে মাধবী দুজনের চোখই ফোলা লাউ চারাটায় ফোটা লাউফুলের মতো অপরূপা সোজা হয়ে বসতে চেষ্টা করে স্বপন এসে হাতদুটো ধরে, আর মাধবী কোমরটা

অপরূপার মনে হয় স্বপনের হাতটা অবিকল বাবুয়ার হাতের মত লাগছে আর মাধবীর মুখটা মাধবীকে ধরে উঠে বসে অপরূপা জড়ানো গলায় বলে একটু জল আন তো শিনা

 

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

Blog at WordPress.com.

Up ↑

%d bloggers like this: