ভুনি ও কইমাছেরা

লিখেছেন সুপ্তশ্রী সোম


গল্পটি এখন শুনতে পারেন অডিও স্টোরি হিসেবেও

পাঠ করেছেন মোনালিসা

ঘরের মধ্যে বসে কাঁথাকানি গুলো গোছ করে রাখছিল ভুনি। দাওয়ার উপর মাচায় মেলা কাঠ কুটো,জ্বালানী । এখন ভাদ্র মাস। কাঠকুটো একটু রোদে না দিলে ওই বোঝার ভিতরে সাপ এসে ঢুকে থাকবে। বর্ষা এখনো শেষ হয়নি। শুকনো জায়গা সবাই খোঁজে। সুন্দর বনের এই বাদা অঞ্চলে সাপের উপদ্রব খুব। প্রতি বছর কত প্রাণ যে সাপের কামড়ে যায়। মানুষের বড় কষ্ট এখানে। এক ফসলি জমি। নোনা মাটিতে মোটা আমন ধানের চাষ হয় ওই একবার ই। আর বাকি সংবচ্ছর মাঠ উদোম হয়ে পড়ে থাকে। শুধু চুচকো ঘাস একটু জলা জায়গায় জন্মায়। তার গোড়া শুকিয়ে ওরা খায়। খেবুর বলে তাকে। ওই চাষের সময়ে আর ধান কাটার সময়ে যা একটু মাঠে কাজ। তা ভুনি র কপালে সে সুখ নেই। ওকে সবাই কাজে নিতে চায়না। তবু কখনো সখনো ধান রুইবার কাজ পায়। তা সে সব কাজ শেষ হয়ে গেছে তাও মাস দেড়েক হতে চললো। এখন ভাদ্রের মাঝামাঝি। খাওয়ার খুব কষ্ট। তবু বাগদি ঘরের মেয়ে বলে ওই ছোট খাপলা জাল নিয়ে বেরোলে একটু খানি চুনো চানা যা পায় তাই দিয়ে এক সাঁঝ হয়ে যায় যদি ভাত জোটে। এই বাগদি পাড়ায় মরদ রা এই সময় শহরের দিকে যায় আর যারা ভাগ্যবান তারা বড় মহাজনের বাড়ি মাহিনাদার হয়ে থাকে। বাঁধা রোজগার। আর তিনবেলা পেট পুরে ভাত। তা খাটতে হয়। মাঠের যত কাজ সব করতে হয় ঘরের ও। তা নইলে ব্যাটাছেলেরা এই সময়ে মাছ ধরে বেচে আর নয়তো ওই পেটে কিল মেরে খেবুর কি শাপলার গোড়া সিদ্ধ দিয়ে পেট ভরায়। বড় বড় সব শরীর । পেটে এক এক থালা ভাত ঢুকে যায় রেল গাড়ির ইঞ্জিনে কয়লার চাঁই দেওয়ার মত। খিদে খুব খিদে। আর সে খিদে ভাতের। গরম কিংবা পান্তা ভাতের পাতেএক ফোঁটা আলু সিদ্ধ কি কাঁকড়া পোড়া দিয়ে । আহ আর কিছু লাগে না কি ?

ভুনি র ঘরে রোজগেরে ব্যাটা ছেলে নেই। ভুনি র ছেলের বাপ মারা গেছে । সে বড় কট্টর জোয়ান ছিল। কি জানি তিন দিনের জ্বরে সে কেন চলে গেল। ভুনি কাঠ রেখে ঘরে ঢোকে। আজ কদিন ধরে ছেলেটার জ্বর। “আজ একবার বাবুদের বাড়ি না গেলিই নয়” ভুনি অস্ফুটে বলে। নিজের ভাষায়। “ওমা আকাশ কালো করে জল আসতেছে যে। এই না রোদে দাওয়া উঠোন ভেসে যাচ্ছেলো ।” ভুনি তাড়াতাড়ি দুচারটে কাঠ যা মেলে দিয়েছিল দাওয়ার উপর তুলতে না তুলতেই হুড়মুড় করে বৃষ্টি নামে। ভাদ্র মাস। হুম করে শব্দ করে রাগটা দেখায় আকাশের দিকে তাকিয়ে ভুনি। হাত দুটো ছুঁড়ে দেয় হাওয়ায়। তার মধ্য যৌবনের না খেতে পাওয়া রোগা হাত বাতাসে শব্দ কাটে। কিন্তু বৃষ্টি বেশ চেপেই এসেছে। ছোট করে ছাড়বেনা। আজ কথা ছিল বড়বাবু দের বাড়ি যাওয়ার। তা মাইল খানেক তো হাঁটতে হবে। বড়বাবুর বাড়ি গে ওই এক বস্তা ধান সিদ্ধ করে রোদ খাইয়ে রোদে মেলে দিতে হবে। তারপর দুদিন সেই ধান রোদে দেওয়া তোলা আবার রোদে দিয়ে একেবারে ঝন ঝনে করে দিলে তবে কলে যাবে। আগে ঢেঁকি তে ভুনি আর পাশের বাড়ির শিবুর মা দুজনে সারা বেলা ধরে পাড় দিত। এখন ধানের কল তাদের পেটে লাথি মেরেছে। তা যা জল নেমেছে আজ আর ধান সিদ্ধ করাবেনা বড় বাবুর বউ । তবু ও পাড়ায় যাওয়া দরকার। বাঁশের মাচার উপর হাত পা জড়ো করে কেঁথা গায় দিয়ে ঘুমোচ্ছে তার ছেলে। আহা পেট টা একেবারে পড়ে গেছে। কাল রাতে একখানা মোটে রুটি খেয়েছে। ছেলের বাপ মারা গেছে তা কবছর যেন হল? একটু থেমে যায় ভুনির ক্ষিপ্রতা। আঙ্গুল দিয়ে ধীরে ধীরে গোনে । সেই যে মাঠে যেবার শীতলা পুজো হলো আর শিবুর বাবা যে কালীপূজা করলো। বাবুদের বড় ছেলের বে হল। ত্যাকন ও তো বেঁচে ছেল ছেলের বাবা। ভুনির হাত থেমে গেছে চার নম্বর কড়ে । ও অতো ভালো করে গুনতে পারেনা। মনে হয় অনেক অনেক দিন ও একা। কি মনে হতে ঘরের বাতার থেকে একটা ভাঙা আয়না নিয়ে মুখ দ্যাখে। চাঁছা ছোলা মুখ। কপালের টিপের পাশে একটা আঁচিল। হাতের ভিতরে উল্কি আর দু গাছা সাদা চুড়ি। মাজা মাজা গায়ের রঙে রোগা হিলহিলে শরীর। মলিন ভিজে আঁচল দিয়ে মুখ মুছে বাইরে বৃষ্টি দ্যাখে ভুনি। কতদিন ধরে সে আর ছেলে কী করে যে বেঁচে আছে। এই গতর। আস্তে আস্তে ছেলের গায়ে কপালে হাত ছোঁয়ায় ভুনি। এখনো গরম।

” আজ যে করি হোক বাবুর বাড়ি যেতি হবে “। বাবুর বউ ওষুধ দেবে খনে। গিন্নিমার খুব দয়ার শরীল”। বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ নেই। দরজায় বসে কপালের উপর হাত দিয়ে বৃষ্টি দেখতেই থাকে ভুনি। এই বাগদি পাড়ায় সবাই ওই নদীর মাছ ধরেই বাঁচতো। বিদ্যাধরী র শাখা নদী এই গ্রামে বয়ে যেত অনেক আগে। ভুনির তখন জন্ম ও হয়নি। ওই জলেই সব ছিল এই পাড়ার সব লোকেদের। নৌকো ও চলতো। কালে কালে সে নদী মজে গেছে। এখন খাল। যার একদিকের মুখ বন্ধ হয়ে রাস্তা হয়েছে। ওর বাবা বড় হাট্টা কাট্টা জোয়ান ছিল। বাবার কাঁধে চেপে সে নদীতে নামতো। তখন সে এই এতটুকুন। নিজে নিজেই হাত নেড়ে ভুনি কথা বলে যায়। সেই নদী এখন ওরই মতো। শুকিয়ে গেছে। তবে অবরে সবরে এই খালেও জোয়ার আসে। এই এত্তো এত্তো মেকো পোনা নিয়ে। কত কত। তখন কদিন কি আনন্দ । ওই মেকো চচ্চড়ি র সাথে লাগে এক থালা ভাত শুধু। আচ্ছা ওই মেকোগুলো বড় হলে কত ক্যাকড়া হতো তাই না ? নিজের মত কথা কইতে কইতে হঠাৎ নজর পড়ে ডোবার দিকে। টানা বৃষ্টিতে ভর ভর হয়েই ছেলো ডোবাটা। ওমা ও কি দেখতেছে ভুনি। ” কই মাছ লয় ? ওই তো একটা ওই ওই পেছনে আর এড্ডা ” । টক্ করে বাঁশের আড়ে বাঁধা খারাই টা নামায়। তার পর তরাক করে জলে নেমে পড়ে। খলবল করে চলা কই টাকে খপ করে ধরে খারাই তে পোরে। “ওমা ধর ধর , ওই আর একডা ” বলতে বলতে দাওয়া থেকে লাফ দেয় ভুনির ছেলে। মা আর ছেলে জ্বর টর ভুলে মাছ ধরতে নেমে পড়ে। ভুনি চিৎকার করে হাত পা নেড়ে নানা আওয়াজ করে। ছেলে কে দাওয়ায় উঠতে বলে। ছেলে শোনেনা। ভুনি হাল ছেড়ে দ্যায়। দ্যাখ দ্যাখ করে বারোটা টা মাছ ধরে ফেলে ভুনি আর ভুনি র ব্যাটা। বৃষ্টির জল পেলে কই মাছ কানকো দিয়ে ডাঙায় ওঠে। কেন কে জানে । বৃষ্টিটাএকটু ধরে এসেছে এতক্ষণে। হুঁশ ফেরে ভুনি র। ছেঁড়া তেলচিটচিটে গামছা আর নিজের শত ছিদ্র শাড়িটা দিয়ে ব্যাটার মাথা মুছিয়ে দিতে থাকে একমনে।

“আমার কিছুই হবেনি, তুই যা দিকিনি বাবুদের বাড়ি ” ধাক্কা দিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে উঁচু বাড়ি দেখায় ভুনির ছেলে। পেট দেখায়। আজ তার জ্বর ছাড়লো। আর ক্ষিধেয় পেটের নাড়ি অব্দি পাক দিচ্ছে। ভুনি বোঝে। কথা সে বলতে পারেনা ঠিক ই কিন্তু বুদ্ধি তার কম নয়। জন্ম ইস্তক বোবা কালা। ভুনি কাপড় নিংড়ে জল বের করে ঘরে ঢুকে মাটির ভাঁড়ের ভিতর হাত দেয়। চুঁচকো ঘাসের গোড়া যাকে ওরা খেবুর বলে ওই এক মুঠো তুলে দেয় ছেলের হাতে। মাছের খারাই হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। হাত নেড়ে ছেলেকে বলে, ‘ আসছি’ । জোরে জোরে পা চালায় ভুনি। দুটো ভাত রাঁধতি হবে। এই বড় বড় জ্যান্ত কৈমাছের বদলে গিন্নিমার কাছ থেকে কিলো দুই চাল আর দশ টা টাকা যে করে হোক নিতেই হবে। গিন্নিমা তরিজুত করে মাছ রাঁধুক তারা মায়ে পোয়ে দু মুঠো ভাত খাবে। আশায় জোরে জোরে পা চালায় ভুনি। বোবা কালা ভুনি। হাত পা নেড়ে নিজের সাথে কথা বলতে বলতে। রান্নার রসায়নের ভার গিন্নিমা র উপরে দিয়ে ভুনি তার আর তার ছেলের রসনার কথা ভেবে উড়ে উড়ে পথ পার হয়। তার বৃষ্টি ভেজা গা ততক্ষণে শুকিয়ে উঠেছে।


এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

Blog at WordPress.com.

Up ↑