নীলাঞ্জন চক্রবর্তী
“বাজলো তোমার আলোর বেণু…” গানের এই লাইনটা শুনেই মহালয়ার ভোরে আমার ঘুম ভাঙে। আমার ঠাকুমা প্রতি বছর মহালয়ার ভোরে তাঁর পুরনো রেডিওয় আকাশবাণীতে “মহিষাসুরমর্দিনী” চালিয়ে দেন। তারপর ঠাকুর ঘরে ধূপ জ্বালিয়ে জোড় হাতে বসে শোনেন। এটা আমাদের বাড়ির প্রাচীন রেওয়াজ। আমাকেও শুনতে হয়।

বাণীকুমারের পরিচালনায় “মহিষাসুরমর্দিনী” বাংলার বেতার জগতে এমন একটা উপস্থাপনা যা দশকের পর দশক ধরে দেশ বিদেশের সমস্ত বাঙালিকে মোহিত করে রেখেছে। প্রায় আশি বছরেরও অধিক সময় ধরে ভারতবর্ষের কোনো প্রোগ্রাম এমন জনপ্রিয়তা লাভ করেনি। মহালয়ার ভোরে বীরেন্দ্র কৃষ্ণের কণ্ঠে তখনকার পুরনো সাউন্ড এফেক্টস-এ ঘরের মধ্যে এমন একটা দৈব ভাব সৃষ্টি করে যা বলে বোঝানো যাবেনা।
এই মহিষাসুরমর্দিনী শুনতে শুনতে আমার মনের মধ্যে একটা ভাবের সৃষ্টি হয়, তখন মনে এক প্রশ্ন জাগে যে আমাদের বাংলায় দুর্গাপুজোর প্রচলন হলো কীভাবে? কেই বা সেটা শুরু করল?
মহালয়া শেষ হলে ঠাকুমাকে জিজ্ঞেস করলাম – ঠাম্মা, দুর্গাপুজোর প্রচলন কে করেছিল জানো?
ঠাকুমা বলল – তুই কী করবি এসব জেনে?
আমি বললাম – জানতে চাই, কলেজে বন্ধুদের বলব।
ঠাকুমা বলতে শুরু করল –
মোটামুটি ষোড়শ শতকের গোড়ার দিকে বাংলায় দুর্গাপুজোর প্রচলন হয়। ১৬১০ সালে বেহালার সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের শারদীয়া দুর্গাপুজো প্রথম শুরু হয়। আবার অনেকের মতে বাংলাদেশের তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ বাংলায় প্রথম দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন। তবে এটা ধরে নেওয়া যায় যে ষোড়শ শতকের দিকেই বাংলাতে দুর্গাপুজোর প্রচলন শুরু হয়। তবে এটাও জানা যায়, তখনকার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বাদে সাধারণ অবস্থাপন্ন লোকেরা যদি শারদীয়া দুর্গাপুজো, মানে অকালবোধন পূজো করতে যেত তাহলে তখনকার ব্রাম্বন পুরোহিতরা বাধার সৃষ্টি করত। কারণ তখনকার মতে অকালবোধন পুজো ছিলো নিষিদ্ধ। রাক্ষস রাজ রাবণ কৃত বাসন্তী পুজোই ছিল স্বীকৃত পুজো।
তখন দুর্গাপুজো কিন্তু এত জনপ্রিয়তা লাভ করেনি। জনপ্রিয়তা বা বাংলার পালাপার্বণের জায়গায় পৌঁছল ইংরেজরা আসার পর। সত্যি কথা বলতে গেলে বাংলায় দুর্গাপুজোকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল কিন্তু ইংরেজরাই। এর একটা কারণও ছিল, বাংলার মানুষের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরী করা। আর দুর্গাপুজোর ব্যাপারে ইংরেজদের উৎসাহে সলতে দিয়েছিলেন তৎকালীন বাংলার দুই রাজা, নবকৃষ্ণ দেব ও কৃষ্ণচন্দ্র রায়। কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন নবদ্বীপের রাজা আর নবকৃষ্ণ নায়েব থেকে হয়ে উঠেছিলেন কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়ির রাজা, ইংরেজদের সহায়তায়।
আসলে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের প্রধান সহায়তা করেছিলেন বাংলার এই দুই রাজা। মীর্জাফর একা বিশ্বাসঘাতক নয়, পলাশীর যুদ্ধের ইতিহাস পড়লে জানতে পারবি আমাদের বাংলারই কত লোক ইংরেজদের হয়ে সিরাজের বিরুদ্ধে লড়েছিল।
সেসব কথা পরে একদিন বলব তোকে।
আমি বললাম – কিন্তু ঠাম্মা, ইংরেজরা দুর্গাপুজোকেই বা কেন বেছে নিলো? বাংলায় তো আরো উৎসব ছিল।
–দুর্গাপুজো বাঙালীর প্রধান উৎসব তাই। আসলে পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের পর ইংরেজরা চাইছিল একটা বিজয় উৎসব পালন করতে। কিন্তু কী করবে সেটা ভেবে পাচ্ছিল না। তখন নবকৃষ্ণ দেব আর ওদিকে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় নিজ নিজ প্রাসাদে দুর্গাপূজা শুরু করলেন, সঙ্গে রবার্ট ক্লাইভকে আমন্ত্রণ করলেন।
বলা বাহুল্য, ক্লাইভ তাদের আমন্ত্রণে গেছিলেন এবং ফলমূল, দক্ষিণা, সোনা দানা উপহার হিসেবে নিয়ে গিয়েছিলেন।
এদের দেখাদেখি ঠাকুরবাড়ির প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরও নিজ গৃহে দুর্গাপুজো শুরু করেন।
এরপর একে একে ছাতুবাবু লাটুবাবুদের বাড়ি, হাটখোলার দত্ত বাড়ি, দর্জিপাড়ার মিত্রদের বাড়ি আরো অনেকে পুজো করেন। আর এই সমস্ত বাবুদের বাড়ি দুর্গাপুজো মানেই ইংরেজদের আমন্ত্রণ ছিল বাঁধা।
কোন জমিদার কোন সাহেবকে নিমন্ত্রণ করে কত বাহারি তোয়াজ করতে পারবে এই নিয়ে লেগে যেত প্রতিযোগিতা। ইংরেজদের আমন্ত্রণ মানেই বাঈজি নাচ, মদের আসর, বাজির প্রদর্শনী, ফানুস ওড়ানো, আমোদ প্রমোদ সব চলতো। নামেই শুধু দুর্গাপুজো, আসলে স্ফূর্তি, পয়সা ওড়ানো আর বাবুয়ানি দেখানোই ছিলো মূল উদ্দ্যেশ্য। কোন বাড়ির পূজো সব থেকে বিলাসবহুল আর জাঁকজমকের হয়েছে, কোন সাহেব এসেছিল, কত লোক খাইয়েছে এই নিয়ে চলত বাবুদের মধ্যে টক্কর। পুজোর দিন গুলোয় দান দক্ষিণা, কাঙাল ভোজন, বাজি পোড়ানো, সব চলত। বড় বড় ঝাড়লন্ঠন আর আলোর রোশনাইতে ভরে যেত গোটা বাড়ি। নাচ মহলে মদের পেয়ালায় তুফান উঠতো। ইংরেজদের জন্য স্পেশাল মদ, আতরের ব্যবস্থা থাকত।
তখন আর একটা রেওয়াজ ছিল, কার নাচ মহলে কোন বিখ্যাত বাঈজী নাচ দেখাতে এসেছে এ নিয়েও চলত রেষারেষি।
–আর কী কী হত তখনকার পূজোয়?
– রোজ আলাদা আলাদা অনুষ্ঠান হত, কোনওদিন কবিগান, কোনওদিন পালাগান, যাত্রাপালা এমন নানারকম। সমস্ত মানুষেরা দেখতে আসত। পুজোর দিন কটা সবার জন্য অবারিত দ্বার।
– আচ্ছা তখন জমিদার বাড়ি ছাড়া পাড়ায় পাড়ায় দুর্গাপুজো হতোনা?
– না রে ভাই, তখনও বারোয়ারি দুর্গাপুজো শুরু হয়নি।
প্রথম বারোয়ারি দুর্গাপুজো শুরু হয় হুগলী জেলায়। বারোজন বন্ধু মিলে পূজো শুরু করে। বারোজন ইয়ার মানে বন্ধু তাই থেকে বারো ইয়ারি বা বারোয়ারি পূজো। বুঝলি? তখনও প্রবল বাধা বিপত্তি সহ্য করতে হয়েছে যারা বারোয়ারি পূজো করতে চেয়েছিল। বাগবাজার সার্বজনীন কলকাতার প্রথম বারোয়ারি পূজো, যা কিনা ডাকের সাজের জন্য বিখ্যাত।
– ঠাম্মা, ডাকের সাজ কী?
– আগেকার দিনে জার্মানী থেকে শোলার কাজ করা প্রতিমার সাজ আসত ডাকের মাধ্যমে বা ডাক ব্যাবস্থার মাধ্যমে। তাই এই সাজের নাম হয়ে যায় ডাকের সাজ। এখন আমাদের বাঙলাতেই হয়।
তবে এই সময় একটা নিষ্ঠুর প্রথাও খুব জনপ্রিয়তা লাভ করে, তা হলো বলিদান প্রথা। কুমড়ো, লাউ, শসা ছাড়াও প্রচুর ছাগ বলি হতো। অনেক জায়গায় মহালয়ার দিন থেকে বলি শুরু হত। যত দিন যেত তত বলির পরিমাণ বাড়ত। শেষ দিনে পূজো প্রাঙ্গণ রক্তে ভরে যেত। বিসর্জনের দিন লোকে সেই রক্ত গায়ে মেখে ঢাক ঢোল পিটিয়ে ঘুরে বেড়াত। এখানে মেয়েদের যোগদান বিশেষ কিছু ছিলনা পুজোর আয়োজন করা ছাড়া, তারা অন্তঃপুর থেকে ছইয়ের আড়াল দিয়ে সব অনুষ্ঠান দেখত।
তবে আর যাই বদলাক, পুজোর আড়ম্বর আর জাঁকজমক, লোক দেখানো কিন্তু এখনও আছে, কিছুই বদলায়নি। এখনও দুর্গাপুজো শুধু উপলক্ষ মাত্র।
তথ্য সহায়তা :- কলকাতা গবেষক শ্রী চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়।




এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান