পুরনো কলকাতার নাম রহস্য

নীলাঞ্জন চক্রবর্তী 

গল্পটি পাঠ করেছেন অমিতকিরণ বন্দোপাধ্যায়

“হেই ইয়ং ম্যান। where are you going now?” 

গম্ভীর বাজখাঁই গলায় পেছন থেকে কে যেন ডেকে উঠল। মনে হল আমাকে উদ্দেশ্য করেই বলা, পিছন ফিরে তাকালাম। রাস্তার গ্যাসলাইটের সামান্য আলোআঁধারিতে দেখে মনে হল কেউ একজন ছায়ামূর্তি ঘোড়ার পিঠে চেপে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। শক্ত মাটির রাস্তায় ঘোড়ার খুরের শব্দ নিস্তব্ধ শহরটাকে খানিক জাগিয়ে তুলল। 

ছায়ামূর্তি আমার নিকটে এগিয়ে আসতে দেখলাম মাথায় হ্যাট পরা, পায়ে গামবুটের মত জুতো ও লং কোট–প্যান্ট পরা একজন দীর্ঘদেহী সাহেব আমার সম্মুখে দাঁড়িয়ে। মাথায় হ্যাট পরার দরুণ মুখ একদমই বোঝা যাচ্ছে না, তার ওপর চারিধার ঘন কালো অন্ধকার। পাশেই গ্যাসবাতির আলোর সাহায্যে সামান্য যেটুকু বোঝা যায় তারই বর্ণনা দিলাম। 

ছায়ামূর্তি সাহেব ইংরেজি ঢঙে বাংলায় বললেন, “কে ঠুমি? এখানে কী করিটেছো?” 

আমি বললাম, “স্যার, থুড়ি সাহেব, আমি তো বাগবাজারের রাস্তা ধরে হাঁটছিলাম তারপর হঠাৎ কেমন যেন মাথাটা ঘুরতে লাগল বনবন করে, কিছুক্ষণ পর পড়লাম রাস্তার ওপরেই তারপর এখন উঠে দেখি পিচ রাস্তার বদলে মাটির রাস্তা, গ্যাসের আলো। এ কোথায় এলাম সাহেব?” 

সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, “এটা কোটো শটাবডি?” 

আমি বললাম, “দু’ হাজার তেইশ।” 

সাহেব বললেন, “টুমি মোর ড্যান হান্ড্রেডস অফ ইয়ারস পিছিয়ে এসেছো। Now you are in the eighteenth century।” 

আমি হাঁ করে ছায়ামূর্তির দিকে চেয়ে থেকে বল্লাম, “কীভাবে? টাইম মেশিনে করে?” 

সাহেব বললেন, “টাইম ল্যুপের মাধ্যমে টুমি পিছিয়ে পড়েছো। টাইম মেশিন বলে কিছু হয় না।” 

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এটা কোন জায়গা সাহেব?” 

সাহেব বললেন, “টুমি যেখানে ছিলে সেখানেই আছ, এটা পেরিন সাহেবের বাগান।” 

আমি বললাম, “সেটা কোথায়?” 

সাহেব বললেন, “টোমরা যেটাকে বাগবাজার বলো টাকেই once upon a time নেটিভরা পেরিন সাহেবের বাগান বলঠো।” 

এরপর সাহেবের মুখ থেকে যা যা শুনলাম তা সহজ বাংলায় বলছি। 

এই বাগবাজারটা আসলে ছিল পেরিন সাহেবের সাজানো গোছানো বিস্তীর্ণ বাগান। এখানে সাহেব মেমরা এক সময় বৈকালিক ভ্রমণ করে বেড়াত। এখানে পেরিন সাহেব একটি বাজারও বসিয়েছিলেন। পেরিন সাহেবের বাগান ও বাজার এই দুইয়ে মিলে হয়েছে বাগবাজার। কাজেই বাগবাজারের নামের সাথে বাঘের কোনো সম্পর্ক নেই। 

এভাবে কল্লোলিনী কলকাতার যে কত নাম লোক মুখে মুখে প্রচারিত হয়ে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে তার কোনো হিসাব নেই। 

এই বাগবাজারের কাছেই ছিল চিত্তেশ্বরীর মন্দির। চিতে নামক এক ডাকাতের হাতেই নাকি এই মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়, তার থেকেই চিত্তেশ্বরী আর তার থেকেই চিৎপুর অঞ্চলের সৃষ্টি। 

এই চিৎপুরের মাটিতেই একসময় ডাকাতের উপদ্রব ছিল ভীষণ। ডাকাত, দস্যু আর কাপালিকদের দাপটেই কাঁপত প্রাচীন কলকাতা। এই চিত্তেশ্বরী মন্দিরে নরবলিও হত অহরহ। 

এছাড়া ধর্মতলার নামকরণের পেছনেও আর এক ইতিহাস। তখন ঘাটাল, আরামবাগ এসব অঞ্চল থেকে জেলেরা এসে বাস করত এই অঞ্চলে। এখানে এসে তারা ধর্মঠাকুরের পুজো করত। এদের উৎসাহদাত্রী ছিলেন স্বয়ং রানী রাসমণি। ধর্ম ঠাকুরের পুজো হত ডোমটুলিতে ধর্মতলার উত্তরে আর তালতলা অঞ্চলে। এই ধর্মঠাকুরের থেকেই এই জায়গার নাম হয় ধর্মতলা। এভাবে ঠাকুর দেবতার নাম থেকেও অনেক জায়গার নাম হয়ে গেছে যেমন কালীঘাট, ওলাইচন্ডিতলা, রাধাবাজার, ষষ্ঠিতলা, রথতলা এরকম আরো অনেক। 

এভাবে বিভিন্ন ঘটনাও কলকাতার নামে জড়িয়ে আছে, এই যেমন কলকাতা আক্রমণের সময় সিরাজের হাতিশালা ছিল বর্তমান হাতিবাগান অঞ্চলে, তার থেকেই এই নাম। 

এখনকার কলকাতাকে আমরা যেভাবে দেখি দেড়শো দুশো বছর আগে কলকাতার এ রূপ ছিল না। চারিধারে বন জঙ্গল, পুকুর ডোবাসমৃদ্ধ জায়গা। এই জলাজঙ্গল থাকার দরুণও অনেক জায়গার নাম হয়ে গেছে নিমতলা, বটতলা, লেবুতলা, তালতলা, পটলডাঙ্গা ইত্যাদি আরো অনেক। এন্টালি এলাকায় নাকি একসময় ছিল হিন্তল গাছের বন। এই হিন্তল থেকেই অপভ্রংশ হয়ে নাম হয়েছে এন্টালি। 

বড়বাজারের নাম হয়েছে কলকাতার সবচেয়ে বড় বাজার বলে নয়। বড় শব্দ এসেছে বুড়ো থেকে। বুড়ো অর্থাৎ বুড়ো শিবের কথা বলা হয়েছে। বুড়ো শিবের বাজার থেকেই সংক্ষিপ্তসারে হয়েছে বড়বাজার। 

১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর কলকাতার জমিদার হলওয়েল সাহেব স্থির করলেন কলকাতাকে তিনি নতুন করে সাজাবেন। ঠিক হল এক এক যায়গায় এক এক পেশার লোকেরা থাকবে। যেমন কুমারটুলিতে কুমোরেরা, কলুটোলায় কলুরা, দর্জিপাড়ায় দর্জিরা, খালাসিটোলায় খালাশিরা, আহিরিটোলায় বিহার উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা গোয়ালারা থাকত। 

রাজভবনের পাশ দিয়ে যে গলিটা চলে গেছে তার একসময় নাম ছিল ফ্যান্সি লেন। এই ফ্যান্সি শব্দটা এসেছে ফাঁসি থেকে। ইংরেজ শাসন যখন এদেশে গেঁড়ে বসেছে, আঠারো শতকের শেষের দিকে ও উনিশ শতকের শুরুর দিকে এই অঞ্চলের পাশ দিয়ে একটি নদী বয়ে যেত। সেই নদীর ধারে ছিল কয়েকটি বড় বড় গাছ। সেই সময় তুচ্ছাতিতুচ্ছ অপরাধেও অপরাধীদের ধরে এনে এই গাছের ডালে বেঁধে ফাঁসি দেওয়া হত। 

এছাড়া কত ইংরেজ সাহেবের নামে এখনো কত জায়গার নাম রয়ে গেছে, বেন্টিংক স্ট্রিট, আর্মহার্স্ট স্ট্রিট, ডালহৌসি – বলে শেষ করা যাবে না। 

এমনভাবে বর্তমান কলকাতায় কত নাম হারিয়ে গেছে কত নাম নতুন সংযোজন হচ্ছে তার কে খবর রাখে? বহতা কলকাতার এটাই নিয়ম। 

————————– 

দীর্ঘ কথাবার্তার পর সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার পরিচয় কী, সাহেব?” 

উনি বললেন, “I’m a doctor। এখন রুগী ডেখিয়া বাংলোয় ফিরিটেছি। You can go with me for night stay.” 

সাহেবের কথা শুনে ভাবলাম একবিংশ শতকের ছেলে হয়ে আঠারো শতকে গিয়ে রাত কাটাতে পারব না। সে এক বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে। 

কাতর স্বরে সাহেবকে বললাম, “এখন দু হাজার তেইশে কী করে ফিরে যাব, স্যার?” 

সাহেব বললেন, “আমার একটি ঘুষিতে।” বলেই ওনার বজ্রকঠিন মুষ্ঠি দিয়ে আমার মুখে মারলেন এক ঘুষি। ছিটকে গিয়ে পড়লাম রাস্তায়, তারপর আসতে আসতে চোখ খুলে দেখি শুয়ে আছি হসপিটালের একটি বেডে। সামনে ডাক্তারবাবু আমার দিকে মোবাইল তাক করে দেখাচ্ছেন, “দেখুন ক’টা বাজে, টানা বারো ঘণ্টা পর আপনার জ্ঞান ফিরল।” তাকিয়ে দেখি সকাল দশটা বাজে, নিচে আজকের তারিখের পাশে সাল লেখা দু’ হাজার তেইশ। এক স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল। 

তথ্যসূত্র –  

কলকাতা – শ্রীপান্থ 

পুরনো কলকাতার কথাচিত্র – পূর্ণেন্দু পত্রী 

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

Blog at WordPress.com.

Up ↑