যমের বাড়ি কলকাতা

গল্পটি পাঠ করেছেন অমিতকিরণ বন্দোপাধ্যায়

“না, না, যমের বাড়ি কেন হতে যাবে? তবে এইভাবে সাধারণ মানুষেরা যদি নতুন জায়গায় এসে পটপট করে মরে যেতে থাকে তাহলে সেই জায়গাকে কী বলবে? তখন যে-ই আসছে কলকাতায়, হয় ম্যালেরিয়ায় ধরছে নাহয় কলেরায় তার পঞ্চত্ব প্রাপ্তি হচ্ছে। জলা জঙ্গলে ভরা তখনকার কলকাতা। রাতে শেয়াল ডাকত।” 

আমরা তাকিয়ে রইলাম স্যারের দিকে। আমাদের স্কুলের বাংলার স্যার উৎপলবাবু খুব সুন্দরভাবে নানা দেশের নানান জায়গার কাহিনী শোনান। কখনো বা আমাজন অববাহিকার মাংসখেকো মাছ বা কখনো অজন্তার গুহাচিত্র। দারুণ লাগে শুনতে স্যারের মুখে। একদম ছবির মত চোখে ভাসে। স্যার যে এই সমস্ত জায়গায় গিয়েছেন তেমন নয়, তিনি নানারকম বই থেকে পড়ে সংগ্রহ করেন এমন সব অজানা তথ্য। স্যার বলেন, “শুধু বই পড়লেই পৃথিবীর অর্ধেক যায়গায় ঘুরে আসা যায়, অর্ধেক অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করা যায়।” 

আজকে লাস্ট পিরিয়ড ইতিহাস স্যার সোমনাথবাবুর ছিল, উনি আজকে আসেননি বলে হেড মাস্টার উৎপল স্যারকে বললেন আমাদের ক্লাশ নিতে। স্যার যখন যা পড়ান আমাদের কখনো পড়া বলে মনে হয় না। মনে হয় যেন গল্প বলছেন। 

সুজয় বলল, “তাহলে কলকাতায় লোকে আসত কেন, স্যার?” 

স্যার বললেন, “প্রধানত জলপথের সুবিধার জন্য। এছাড়া কলকাতা থেকে বিভিন্ন জায়গায় খুব সহজে যাতায়াত করা যেত। ভৌগোলিক আরো কিছু কারণে কলকাতা খুব সুবিধাজনক জায়গা এটা বুঝেছিল ধূর্ত ইংরেজরা। আর ইংরেজরা আসার ফলে দলে দলে অন্যান্য জায়গার মানুষও আসতে থাকে কাজের সন্ধানে। তবে কী ইংরেজ কী দেশীয় লোক, মরতে হত সকলকেই। শুধু যে রোগে ভুগেই মরত তেমন নয়। কলকাতায় ডাঙায় ছিল বাঘ, জলে কুমীর আর জঙ্গলে ডাকাত – এই নিয়েই চলত তখন কলকাতায় বসবাস। সুন্দরবন তখন অনেক বড় ছিল, কলকাতার সাথে সংযুক্ত। কাজেই বাঘ, বন্য শুকরের মত হিংস্র জানোয়ারের প্রাদুর্ভাব ছিলই। অর্ধেক লোক তো এই বাঘের পেটেই ইহলীলা সাঙ্গ করত। 

রাতের বেলা সে সময়ের লোকেরা হাতে লাঠিসোঁটা নিয়ে বের হত, এত ডাকাতের উৎপাত ছিল। রাত হলেই শোনা যেত নরবলির চিৎকার। ঢাক, কাঁসর ঘণ্টার শব্দ। কলকাতায় এমন অনেক কালীবাড়ি আছে যা একসময় ডাকাতদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। 

তবে বেশিরভাগ লোকে মরত কলেরায়, ম্যালেরিয়ায়, পেটের রোগে অথবা অজানা কোনো জ্বরে। এত রোগ ও রোগীর কারণে ডাক্তারেরও অভাব ছিল না। তবে দেশীয় লোকেদের চিকিৎসার জন্য ছিল কবরেজি, হাকিমি, ঝাড়ফুঁক, তন্ত্রমন্ত্র, তাবীজ কবচ এইসব। এতে রোগী বাঁচল কি মরল তাতে কোনো অসুবিধা নেই, বরং এই সমস্ত চিকিৎসার প্রতিই বিশ্বাস ছিল অগাধ। 

তবু দেশীয় গাছগাছড়ার মাধ্যমে কিছু অসুখ সারলেও সাহেবি চিকিৎসা ছিল আরো ভয়ঙ্কর। কোনো কঠিন রোগব্যাধি হলে সাহেব চিকিৎসকেরা রোগীর শরীরে সিরিঞ্জ ঢুকিয়ে গাদাখানেক রক্ত বের করে ফেলে দিত। তাদের ধারণা ছিল শরীর খারাপ হয়েছে যখন, রক্তেরই কোনো দোষ আছে নিশ্চয়ই, তাই রক্ত বের করে ফেলে দেওয়া। বেচারা রোগী তখন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা পড়ত। এই ছিল তখনকার চিকিৎসা পদ্ধতি, এটাই বিজ্ঞান। কলকাতা তো কোন ছার, খোদ ইংল্যান্ডেও তখন একই অবস্থা। 

কাজেই কলকাতার মানুষ তখন কেউ বিনা চিকিৎসায় মরছে তো কেউ চিকিৎসা করে। মরুক বা বাঁচুক, ডাক্তারের ফী দিতেই অনেক লোকের হিমশিম অবস্থা, তবু রোগীর অভাব হত না, বরং অভাব ঘটত ডাক্তারের। তখন কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে ডাক্তার ধরতে হত রোগীদের, এমনও দেখা গেছে। 

শল্যচিকিৎসা পদ্ধতি তখনও শুরু হয়নি। তাই ওপর ওপর রোগীকে দেখে, পরীক্ষা করে কিছুটা বিজ্ঞান কিছুটা আন্দাজের ওপরে ভর করেই চিকিৎসা করতে হত তখন ডাক্তারদের তাই রোগীর বাঁচামরা অনেকটাই নির্ভর করত ঈশ্বরের হাতে। 

ঠিক এই কারণে তখনকার মানুষ নানা রোগের উপশমের জন্য নানান ঈশ্বরের উপাসনা করতে শুরু করল। সাপে কাটলে মা মনসার পুজো, বসন্ত রোগে ধরলে শীতলা মাতার পুজো এমন নানান পুজো, মানত, উপস করেই দিন কাটত কলকাতার মানুষ জনের। এমনকী বাঘে যাতে না ধরে তার জন্য বনদেবীর পুজো করত। মানুষ নিরুপায় হয়েই ঈশ্বরের শরণার্থী হয় সে বিশ্বাসে হোক কি অবিশ্বাসে। প্রথম দিকে মানুষ ভয়ে ভক্তিতে পুজো করলেও আজ তা উৎসবের আকার নিয়েছে। 

এভাবে একবার মড়ক শুরু হলে গ্রাম কে গ্রাম উজাড় হয়ে যেত। বিনা চিকিৎসায় সংক্রামক ব্যাধিতে একেকটা গ্রাম খালি হয়েযেত। কোনো পচা ডোবা, খানাখন্দে পচা গলা মানুষের দেহ পড়ে থাকত। দেহ সৎকারও করতে পারত না অনেকে। তবু মানুষ আসত কলকাতায় জীবিকার সন্ধানে, বাঁচার আশায়, আরো ভাল থাকতে।” 

ক্লাশ শেষের ঘণ্টা পড়ল। আমি পাশের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম সামনের তিন রাস্তার মাথায় একটা মরা ইঁদুরকে নিয়ে চার পাঁচটা কাক কাড়াকাড়ি করছে। একটা সময় হয়ত এখানেই কোনো পচা ডোবার ধারে এমনই এক দুপুরবেলা ততধিক পচা কোনো মানুষের মৃতদেহ নিয়ে শেয়াল কুকুরে কাড়াকাড়ি করত। ভাবলেই গা-টা কেমন শিউরে ওঠে। 

তথ্যসূত্র –  

পুরনো কলকাতার কথাচিত্র – পূর্ণেন্দু পত্রী 

কলকাতা – শ্রীপান্থ 

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

Blog at WordPress.com.

Up ↑