সুনেত্রা সাধু
আমার স্কুলের সহপাঠী অর্চনা হেমব্রোমের গলায় বাঁধা ক্রুশবিদ্ধ যীশুর একটি লকেট আর একটি ছোট ছবি ছাড়া আমার সাথে যীশুর আর কোনো সম্পর্ক ছিল না। আমাদের ছোট শহরে অসংখ্য হিন্দু মন্দির আর গোটা চারেক মসজিদ থাকলেও চার্চ ছিল না একটাও, তাই কেক ছাড়া বড়দিনের আর বিশেষ কোনো মাহাত্ম্য ছিল না।স্যান্টা আমাদের বাড়িতে কখনো আসেনি, তাই গিফটের প্রশ্নই ছিল না। গ্রিটিংস কার্ড আর চকচকে ইংরেজি বইয়ে এক্স ফর x mas Tree ছাড়া সাজানো ক্রিস্টমাস ট্রি দেখিনি কখনো। ইচ্ছে থাকলেই যে দেখা যাবে এমন সম্ভাবনা এক্কেবারেই ছিল না।তাই ইচ্ছে করতেও ভয় করত। শুধু কলকাতাবাসী ঘোষকাকার কাছে গল্প শুনেছি সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল, ভিক্টোরিয়া, চিড়িয়াখানা আর দোতলা বাসের। আমাকে চার্চ দেখানোর কেউ ছিল না।তাতে অবশ্য আমার কোনো দুঃখ ছিল না কারণ সেই বয়সেও ঈশ্বর আমায় অসম্ভব কল্পনাশক্তি দিয়েছিলেন, যার বলে আমি চাইলেই সেন্ট পলস চার্চের গির্জার ঘন্টা শুনতে পেতাম।
তখন প্রায় সমস্ত সিনেমাতেই খ্রিস্টান মহিলাদের চরিত্রগুলি ছিল অতি আধুনিক, তারা ছোট স্কার্ট পরতে পারত, বল ড্যান্স করত, সিগারেট খেত, চাকরি করত, সর্বোপরি তারা তুমুল স্বাধীন ছিল, তাদের সেই স্বাধীনতা আমার চোখ টানত। ভগিনী নিবেদিতা, মাদার টেরেসা কোন দেশ থেকে এদেশে এসে মানুষের সেবা করলেন এমনকি অর্চনা হেমব্রোম পর্যন্ত সেই কোন সুদূর পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এসে আমাদের ইস্কুলে পড়ছে, আর আমি তখনো পর্যন্ত একটাও চার্চ দেখিনি।
আমাদের ইস্কুলে ক্লাসঘর আর হোষ্টেল এক চত্ত্বরেই ছিল তাই টিফিনবেলায় অর্চনা ভাত খেতে হোষ্টেলে যেত, মাঝে মাঝে আমিও যেতাম পিছু পিছু। ডাইনিং রুম বলে কিছু ছিল না, থালায় ভাত এনে সে নিজের ঘরের মেঝেতে বসেই খেত। আমাকে বসতে দিত টান টান করে তাঁতের চাদর পাতা চৌকিতে। ঘরের আর এক পাশে থাকত মালতী মূর্মু, দুজনেই আদিবাসী। ওদের ঘরের পরিচ্ছন্নতা দেখে অবাক হতাম আমি। দেয়ালের একটা তাকে সাজানো থাকতো ছোট্ট একটি যীশুর ছবি। মাথায় কাঁটার মুকুট, দুটি মায়াবী চোখ আর হৃদয় জোড়া আলোর জ্যোতি। অর্চনা আর মালতী ভাত খেত আর আমি কাল্পনিক গল্প জুড়তাম যীশুর সাথে।
ক্রুশবিদ্ধ যীশুর করুণ মুখ দেখে কান্না পেত আমার। ঈশ্বরের অপমৃত্যু ভাবাত আমায়। হিন্দু ধর্মের সর্বশক্তিমান ঈশ্বরদের সাথে যীশুর কোনো মিলই ছিল না। আমি মনে মনে জিজ্ঞেস করতাম
– “তোমাদের দেশে অমৃত পাওয়া যেত না? সমুদ্র তো অনেক ছিল, মন্থন করতে পারোনি! জানো, আমাদের দেশে ঈশ্বর কেন কত অসুরেরও মৃত্যু হয় না, রক্তবীজের এক ফোঁটা রক্তে আরও একশটা রক্তবীজ জন্মায়। পেরেক ঠুকে ঠুকে তোমার শরীর থেকে ওরা এত রক্ত বার করে দিল তার থেকে আর একটা যীশু জন্মাল না! দেখো তোমার মায়ের কত কষ্ট।”
যীশু বলত – “আমি তো ঈশ্বর নই, আমি তো মানুষ। তোমরা আমার ভিতর ঈশ্বর দেখেছ। জানো কি, সব মানুষের ভিতরেই ঈশ্বরের বাস।”
-“আমার মধ্যে?” জিজ্ঞেস করতাম আমি।
যীশু বলত – “আছে আছে, সবার মধ্যে আছে। খুঁজে দেখো।”
ছেলেবেলার সেই কোমল বিশ্বাস নিয়ে আজও আমি মানুষের মধ্যে ঈশ্বর খুঁজে চলেছি। সত্যি বলছি, নিরাশ হইনি কখনো, ঈশ্বর প্রতি মুহুর্তে প্রমাণ করেছেন তিনি সত্যিই আছেন।




এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান