শতবর্ষ পেরোনো কল্লোল পত্রিকা 

মানস শেঠ

গল্পটি পাঠ করেছেন সুব্রত চক্রবর্তী

১৯২৩ খ্রিস্টাব্দ। মাত্র পাঁচ বছর আগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগুন নিভেছে। তারও পাঁচ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পেয়েছেন। সাহিত্য পত্রিকার জগতে তখন রবীন্দ্রনাথের ভাষায় হৃদয় লুঠ করা ‘বঙ্গদর্শন’, ‘ভারতী’, ‘সাহিত্য,’ পত্রিকার দিন শেষ। ‘সবুজপত্র’ সাধু ভাষার প্রচলিত রীতি ত্যাগ করে রবীন্দ্রনাথের সমর্থনে চলিত ভাষায় আকাশ-বিহারী। একটা নতুন কিছু করার জন্য, প্রচলিত ব্যবস্থাকে অতিক্রম করে এগিয়ে চলার প্রেরণায় সবদিকেই যেন বাঁধন ছিন্ন করার উৎসব। এমনই লগ্নে ১৯২১-এর ৪ঠা জুন চারজন যুবক যুবতী তৈরি করলেন ‘ফোর আর্টস ক্লাব’ বা ‘চতুষ্কলা সমিতি’। তাঁরা হলেন গোকুল নাগ, দীনেশ রঞ্জন দাস, সতীপ্রসাদ সেন এবং সুনীতি দেবী। উদ্দেশ্য সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চাকেন্দ্র স্থাপন। প্রত্যেকের একটি করে গল্প নিয়ে ‘ঝড়ের দোলা’ নামে একটি গল্পের বইও বেরিয়েছিল। এই চতুষ্কলা সমিতিই ছিল ‘কল্লোল’ পত্রিকার কল্পারম্ভ। 

১৩৩০ বঙ্গাব্দের বৈশাখে যার জন্মলাভ, ১৩৩৬-এর পৌষমাসে তার আয়ু নিঃশেষিত। মাত্র ৬ বছর ৯ মাসের পরমায়ু নিয়ে কর্ণের রথচক্রের মত বাংলা সাহিত্যের ভূমিতে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল এই পত্রিকা। সাহিত্যের ইতিহাসে মুখরিত রথচক্রে এই স্বল্পায়ু পত্রিকা ‘কল্লোল’-এর কলধ্বনি নিতান্ত অশ্রুত নয়। ১৩২৯ বঙ্গাব্দের চৈত্র সংক্রান্তির দিন গোকুল নাগ লিখছেন –আমার ব্যাগে দেড় টাকা আর দীনেশের ব্যাগে টাকা দুই ঠিক করলুমকল্লোলবের করবসেই টাকায় কাগজ কিনে হ্যাণ্ডবিল ছাপালাম চৈত্র সংক্রান্তির দিন রাস্তায় বেজায় ভিড়, জেলেপাড়ার সঙ দেখতে বেরিয়েছে সেই ভিড়ের মধ্যে দুজনে আমরা হ্যাণ্ডবিল বিলোতে লাগলাম 

বঙ্কিমচন্দ্র, সুরেশচন্দ্র সমাজপতি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত পত্রিকাগুলির সঙ্গে কল্লোল পত্রিকার পার্থক্য অতীব স্পষ্ট। এঁরা সকলেই দিকপাল সাহিত্যিক এবং সাহিত্য সমালোচক। তুলনায় কল্লোলের গোকুল নাগ এবং দীনেশরঞ্জন বাংলা সাহিত্যে তখন সম্পূর্ণ অপরিচিত। তবু এক অপরিমেয় প্রাণশক্তিতে পত্রিকা প্রকাশে এঁদের উদ্যোগ গ্রহণ। প্রথম বর্ষের প্রথম সংখ্যার মোট ১২টি রচনার মধ্যে সতীপ্রসাদ সেন ব্যতীত ‘ফোর আর্টস ক্লাব’-এর অন্য তিনজনের রচনা বর্তমান। তবে ওই সংখ্যাতেই দীনেশরঞ্জনের দুটি রচনার প্রথমটি ‘কল্লোল’ নামে কবিতা,অন্যটি গল্প – ‘ফুলের আকাশ’। গোকুল নাগের ধারাবাহিক উপন্যাস ‘পথিক’ এবং সুনীতিদেবীর গল্প ‘বীণা’। ‘কল্লোল’ কবিতায় উচ্চারিত হলো অবিশ্রাম কলরোলের কথা – আমি কল্লোল শুধু কলরোল ঘুমহারা নিশিদিন/অজানা জানার নয়নের বারি/নীল চোখে মোর ঢেউ তুলে তারি/পাষান শিলায় আছাড়িয়া পড়িফিরে আসি নিশিদিন 

‘কল্লোল’-এর সূচনা থেকে প্রথম পনেরো মাস প্রতি সংখ্যার শুরুতেই কবিতা। পরে মাঝে মাঝে তা পরিবর্তিত। কাজী নজরুল ইসলাম দ্বিতীয় সংখ্যা থেকেই কল্লোলের কবি। ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ নিয়েই নজরুলের অনুপ্রবেশ। তবে একথা অনস্বীকার্য, গল্পের কাগজ হিসেবে এই সাহিত্যপত্রের যাত্রারম্ভ এবং প্রথম বর্ষের প্রথম সংখ্যাতেই তাঁদের ঘোষণা – “কল্লোল মাসিক গল্পসাহিত্য” – দ্বিতীয় বর্ষের পঞ্চম সংখ্যা পর্যন্ত ১৭ মাস এই ঘোষিত নিয়ম অব্যাহত ছিল। পরে তার পরিবর্তন করা হয়। 

প্রচলিত সাহিত্যরীতিকে অস্বীকার করে একটা নতুন কিছু করার জন্য কল্লোলের কলরোল। কিন্তু সাধ আর সাধ্যের মধ্যে সামঞ্জস্যের অভাবে তা যথেষ্ট নয়। উৎসাহ ছিল যথেষ্ট কিন্তু অভাব ছিল অর্থের। তবু ‘কল্লোল’ বেরিয়েছে। সাড়ে তিন টাকা দিয়ে একটা ছোট প্রেস থেকে হ্যাণ্ডবিল ছাপানোর আগেই ‘কল্লোল’ ছাপা শুরু হয়েছে। দীনেশরঞ্জন লিখেছেন – ইহার পূর্ব্বেই কিছু কিছু কপি প্রেসে ছাপিতে দেওয়া হয় বিধাতার সাহায্যে ১৩৩০এর ১লা বৈশাখ কল্লোল ছাপিয়া বাহির হইল পত্রিকার আর্থিক দৈন্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে অফিস ঘরও ছিল সেরকম। ১০/২ পটুয়াটোলা লেনে ছিল দীনেশরঞ্জনের মেজদাদা বিভুরঞ্জনের দু’কামরার বাড়ি, সেখানেই আট ফুট বাই দশ ফুট ছোট একটা ঘরে ‘কল্লোল’-এর অফিস। ১৩৩১-এর ভাদ্র মাসে অফিস অবশ্য স্থানান্তরিত হয়েছিল ২৭ নং কর্নওয়ালিস স্ট্রীটে, কিন্তু বছর দেড়েক পরেই আবার পুরোনো ঠিকানায় ফিরে এসেছিল। আমহার্স্ট স্ট্রীট ও বিবেকানন্দ রোডের সংযোগস্থলের কাছে দীনেশরঞ্জন তার এক বন্ধুর প্রেসে ‘কল্লোল’ ছাপাবার ব্যবস্থা করেন। এর পর পত্রিকা ছাপা হয়েছে ১১১/৪ মানিকতলা ষ্ট্রিটের কোহিনূর প্রেসে, ৩৩-এ মদন মিত্র লেনের বাণী প্রেসে, ২-এ অক্রুর দত্ত লেনের রহস্য লহরী প্রেসে, ২৯-এ রামকান্ত মিস্ত্রী লেনের ক্যালকাটা প্রিন্টিং ওয়ার্কসে। এরকম বিভিন্ন ছাপাখানায় ‘কল্লোল’ ছাপা হয়েছে। একই ভাবে পত্রিকার প্রচ্ছদেরও পরিবর্তন হয়েছে বেশ কয়েকবার, তবে প্রতিটিতেই ফুটে উঠেছে – তরুণ সমুদ্রহৃদয়ের সংঘাত, উচ্ছ্বাস, আগ্রাসন আর সীমাহীন কল্পনাভিসার 

পত্রিকায় সম্পাদক হিসাবে ছাপা হত দীনেশরঞ্জনের নাম, গোকুলচন্দ্র ছিলেন সহকারী সম্পাদক। কিন্তু গোকুলচন্দ্রই ছিলেন আসল কর্ণধার। অর্থক্লিষ্ট পত্রিকাকে বাঁচাতে বিজ্ঞাপন সংগ্রহ, গ্রাহক সংখ্যাবৃদ্ধি, মুদ্রণ কার্যের তদারক সবই গোকুল একা সামলেছেন। গোকুল নাগ ছিলেন শিল্পী এবং কৃতী ফটোগ্রাফার। আর্ট স্কুল থেকে বেরিয়ে, প্রত্নতত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজে নিযুক্ত হয়ে পুণেতে চলে যান। বছরখানেক বাদে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। বম্বের সলিসিটর সুখতঙ্কর ও তার স্ত্রী মালিনী গোকুলকে খুবই স্নেহ করতেন; তাদের যত্নে তিনি সেরে উঠলেও চাকরি করার অবস্থা ছিল না। কলকাতায় ফিরে এসেও স্বস্তি নেই, বিধবা দিদি ও তার চার ছেলেমেয়ের ভার গোকুলের উপর পড়ে। দাদা কালিদাস নাগ উচ্চশিক্ষার্থে ইওরোপে। কিছুদিন বাদে দাদা ফিরে এলে প্রাণে বল এল গোকুলের। কিন্তু বেশীদিন নয়, শিবপুরের বাড়িতে আবার অসুস্থ হয়ে পড়ল গোকুল। সেই অবস্থাতেই চলে সাহিত্য রচনা। ডাক্তার পরীক্ষা করে বলেন যক্ষায় আক্রান্ত হয়েছেন গোকুল। ‘কল্লোল’-এর বন্ধুরা প্রায়ই আসতেন শিবপুরের বাড়িতে ; গভীর সহমর্মিতায় আপ্লুত করে রোজ আসতেন সাহিত্যিক পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়। ডাক্তারের পরামর্শে ঠিক হল গোকুলকে দার্জিলিঙে নিয়ে যাওয়া হবে, সঙ্গে দাদা কালিদাস নাগ এবং পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়। কাশীর ইণ্ডিয়ান প্রেসে তখন গোকুলের লেখা বই ‘পথিক’ ছাপা হচ্ছে। ডাকে প্রুফ পাঠানো হলে পবিত্র সেটা গোকুলকে পড়ে শোনাতেন এবং প্রয়োজনীয় সংশোধন করে দেওয়া হত। ‘পথিক’ পরে ধারাবাহিকভাবে ‘কল্লোল’-এ প্রকাশিত হয়েছিল। ১৩৩২-এর ভাদ্র মাসের শেষে গোকুল নাগের অসুখ বেড়ে যায়; খবর পেয়েই বন্ধু দীনেশরঞ্জন ছুটলেন দার্জিলিঙে। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত তাঁর ‘কল্লোল যুগ-এ লিখছেন – 

দীনেশদা কোমর বাঁধলেন ঠিক করলেন পায়ে হেঁটেই চলে যাবেন দার্জিলিঙ সেই ঝড়জলের মধ্যে গহনদুর্গম পথে রওনা হলেন দীনেশদা সেটাইকল্লোলেরপথ, সেটাইকল্লোলেরডাক বারো ঘণ্টা একটানা পায়ে হেঁটে দীনেশদা দার্জিলিং পৌঁছুলেন জলকাদারক্ত সে এক দুর্দম যোদ্ধার মূর্তিতে 

পরের দিন দুপুর থেকেই চঞ্চল হয়ে উঠল গোকুল। ১৩৩২-এর ৮ই আশ্বিন মাত্র একত্রিশ বছর বয়সেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেন গোকুল নাগ। শোকাহত নজরুলের কবিতা ‘গোকুল নাগ’ বেরোল অগ্রহায়ণের ‘কল্লোল’-এ। আর একটি কবিতা ‘যৌবন পথিক’ এসে পৌঁছল ঢাকা থেকে। লেখক তখনও অপরিচিত। নাম শ্রী বুদ্ধদেব বসু। তখন কেই বা জানত, এই লেখকই একদিন ‘কল্লোল’-এ তথা বাংলা সাহিত্যে গৌরবময় নতুন অধ্যায় যোজনা করবেন। 

দীনেশরঞ্জনের আর্থিক অবস্থাও ছিল শোচনীয়। জীবিকার তাগিদে নানা পেশা ও কর্মজীবন তাকে বেছে নিতে হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। স্বদেশী আন্দোলনের ঢেউয়ে শিক্ষাও ছিল অসম্পূর্ণ, তিনিও ছিলেন শিল্পী ও কল্লোল পাবলিশিং হাউসের প্রতিষ্ঠাতা। মেট্রোপলিটন কলেজের অধ্যক্ষ সারদারঞ্জন রায়ের ছিল স্পোর্ট্‌স গুডসের দোকান, সেখানে কিছুদিন সেলসম্যানের কাজ করেছেন দীনেশরঞ্জন; ছেড়ে দিয়ে ওষুধের দোকানে চাকরি করেছেন। সেটাও ছেড়ে বই-এর কার্টুন আঁকা, প্রচ্ছদ তৈরীর কাজ করেছেন। ‘শনিবারের চিঠি’র প্রথম প্রচ্ছদটি দীনেশরঞ্জনেরই আঁকা। গোকুলের অকাল মৃত্যুর পর ভগ্ন হৃদয় দীনেশরঞ্জন একাই পত্রিকা চালিয়েছেন। 

কল্লোলের মোট ৮১টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। প্রথম সংখ্যাতেই মাসিক গল্প সাহিত্য হবার বিজ্ঞাপন প্রকাশ হলেও, প্ৰশ্ন উঠেছিল কবিতা ছাপা হবে না? তা ছাড়া পত্রিকাকে সব ধরণের পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে বিষয়ের বৈচিত্র থাকতেই হবে। পাঠকসংখ্যা কম হলে অর্থাগমও হ্রাস পাবে। তাই ১৩৩১-এর ভাদ্র সংখ্যার পরেই বিজ্ঞপ্তিটি পরিত্যক্ত হয়েছিল। ‘কল্লোল’-এ কবিতা বেরিয়েছে অজস্র, লিখেওছেন অনেকে। পত্রিকার জীবদ্দশায় প্রকাশিত মোট ৮১টি সংখ্যার একমাত্র ১৩৩৪-এর কার্তিক সংখ্যা ছাড়া ৮০টিতেই প্রকাশিত হয়েছে কবিতা। বিখ্যাত লেখকদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ১২টি, জীবনানন্দ ১২টি, বুদ্ধদেব বসু ১৪টি , অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত ১৫টি, প্রেমেন্দ্র মিত্র ৯টি এবং নজরুল ২৯টি কবিতা রচনা করেছেন ‘কল্লোল’-এর জন্য। 

সুসম্পাদিত পত্রিকাতে সাধারণতঃ কতকগুলি ‘ফিচার’ বা বিভাগ থাকে। ‘কল্লোলে’রও এরকম কিছু বিভাগ ছিল। ‘সংগ্রহ’ বিভাগে থাকত কোনো গল্প বা উপন্যাস থেকে নির্বাচিত সংক্ষিপ্ত কিছু সুভাষিতাবলী। ‘আলোচনা’ বিভাগটি ছিল পুস্তক পরিচয় বা কিছু সাহিত্য ভাবনা নিয়ে তৈরি। এর পরিবর্তে কোন কোন সংখ্যায় ‘পুস্তক পরিচয়’ও প্রকাশিত হয়েছে। দেশ বিদেশের নানা সংবাদ নিয়ে কিছু মন্তব্য সহ প্রকাশিত হ’ত ‘সমাচার’। অপর একটি ফিচার ‘পরিচয় লিপি’। এটির উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে পত্রিকায় বলা হয়েছে – কল্লোলে গত এক বৎসর ধরিয়া পরিচয় লিপি লেখা হইতেছে এই পরিচয় লিপির উদ্দেশ্য, লেখক বা লেখিকাদের রচনার ভিতর যে একটি বিশেষ ভাব থাকে তাহা পাঠকপাঠিকাদের নিকট উপস্থিত করা ‘ছবি’ ফিচারটি ছিল শিল্পীদের শিল্প কর্মের বিষয় নিয়ে আলোচনা। দীনেশরঞ্জন যখন সম্পাদক হন, তখন তিনি অনেকগুলি বিষয়কে একত্রিত করে ‘ডাকঘর’ নামক একটি বিভাগের প্রবর্তন করেন। এতে পুস্তক পরিচয়, দেশ বিদেশের কথা, সাহিত্য বিষয়ক আলোচনা ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত হত। এই বিভাগটির গুরুত্ব ছিল এই কারণে যে, এটি পর্যালোচনা করলে সমকালীন অনেক জ্ঞাতব্য তথ্যের সন্ধান পাওয়া যায় এবং পত্রিকার সম্বন্ধেও সামগ্রিকভাবে একটি ধারণা গড়ে ওঠে। পরে এটি উঠে গিয়ে ‘প্রবাহ’-এর স্থলাভিষিক্ত হয়। ‘কাহিনী’ নামে একটি বিভাগ শুরু হয়েছিল ১৩৩০-এর মাঘ সংখ্যা থেকে। এখানে থাকত দেশ বিদেশের সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। লেখক ছিলেন মুখ্যতঃ নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়। বহু বিদেশী সাহিত্যিকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে ‘কল্লোল’ দাবী করতে পারে। তবে উল্লিখিত ফিচারগুলির কোনটিই সব ক’টি সংখ্যায় ছিল না। এগুলি ছিল অনিয়মিত। সব মিলিয়ে যেন একটা স্থিতিশীলতার অভাব, বিদ্রোহের ছায়া। 

কল্লোল পত্রিকা যখন প্রকাশিত হচ্ছে, তখন বিশ্বের ইতিহাসে ঘটে গেছে রুশ বিপ্লব। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরেই এই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব মানুষের চেতনার জগতে যে উল্লেখযোগ্য আলোড়ন তুলেছিল যার ঢেউ এসে পৌঁছেছিল এই বাংলার কূলেও। সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনের একটা হাতিয়ার হিসাবে অনেকেই এটা বেছে নিয়েছিলেন। ১৯১৯ সালে বিপিনচন্দ্র পাল তার বক্তৃতায় তুলে ধরলেন বলশেভিক আন্দোলনের তাৎপর্য। পরের বছরে অক্টোবর মাসে প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি। চরম অর্থনৈতিক অব্যবস্থা ও সামাজিক অস্থিরতার পরিমন্ডলে একটা দিশা খুঁজে পেতে অনেক শিক্ষিত ব্যক্তিও এর অনুবর্তী হলেন। এদের অনেকেই ছিলেন তরুণ ও কর্মহীন যুবক। পত্রিকাটির বহু রচনার মধ্যে তাই দারিদ্রের বিবরণ, শোষণ, সাধারণ মানুষের আখ্যান ও হৃদয়াবেগের কথা স্বতস্ফূর্তভাবেই স্থান পেয়েছে। এই উন্মাদনার প্রকাশ এতটাই তীব্র হয়ে পড়েছিল যে এই সময়কে একটি সন্ধিক্ষণ বা যুগের সঙ্গে তুলনা করেছেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। এটাই ‘কল্লোল যুগ’ বা কল্লোলের কাল। কিন্তু গোপাল হালদারের দৃষ্টিভঙ্গীতে এটা ‘হুজুগ’। সে যাই হোক, এই হুজুগ বা পরিবর্তনের বার্তা নিয়েই ‘কল্লোল’-এর আত্মপ্রকাশ। 

অন্যান্য অনেক মাসিক পত্রিকা থেকে ‘কল্লোল’-এর একটি বিশিষ্টতা এখানেই পত্রিকাটি সাহিত্য জগতে যে রকম আলোড়ন তুলেছিল, এতে প্রকাশিত রচনা নিয়ে যে বিরূপ সমালোচনা বা সরব সমর্থনের ঢেউ উঠেছিল, অন্যান্য পত্রিকার ক্ষেত্রে তা দেখা যায়নি। এর কারণও ছিল। রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ও সাহিত্য ক্ষেত্রে তার ধারার অনুকরণীয়তা তখন সর্বব্যাপী। অনেকে এই গণ্ডী থেকে বেরিয়ে এসে নিজস্ব ভাব ও চিন্তা নিজের ভাষায় নিজের মত করে প্রকাশ করতে উন্মুখ; কিন্তু করতে গিয়েই সামনে যেন পথ রোধ করেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য জগতে তার অবদান ও রচনার উৎকর্ষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করেও মনে হয়েছে তার রচনা যেন বড় বেশী নৈতিকতার বেড়াজালে আবদ্ধ। সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, উদ্ভুত যন্ত্রণা, অনুভূতি ও আবেগের ভাষা ও প্রকাশ অনেক বেশী স্থূল, এ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া সত্য ও বাস্তবকে অস্বীকার করারই নামান্তর। এটাই ছিল সমসাময়িক কিছু সাহিত্য রচনায় উৎসুক ও আগ্রহী যুবকের দৃষ্টিভঙ্গী। সে সময়ে সীমাহীন দারিদ্র ও কর্মাভাব মানুষের জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে চরম নৈরাশ্য ও অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে সমকালীন লেখকদের সাহিত্য রচনায় এ সব বিষয় ছায়া ফেলবে এটাই স্বাভাবিক। অনেকেই এই অব্যবস্থার জন্য দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী কালের দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কট ও দিশাহীন সমাজ ব্যবস্থাকেই দায়ী করেছেন। এই অভাব ও বঞ্চনার পীড়নে ক্লিষ্ট তরুণ যুবকদের একটি অংশ শুদ্ধতার দোহাই দিয়ে বাস্তবের রূঢ়তাকে অস্বীকার করতে চান নি। এই বাঁধন ছেঁড়ার জয়গানই ‘কল্লোল’-এর লেখকরা গাইতে চেয়েছিল। বুদ্ধদেব বসু লিখলেন – যাকে কল্লোলযুগ বলা হয় তার প্রধান লক্ষণই বিদ্রোহ, আর সে বিদ্রোহের প্রধান লক্ষ্যই রবীন্দ্রনাথ অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তও বলেন, ভাবতুম রবীন্দ্রনাথই বাংলা সাহিত্যের শেষ, তার পরে আর পথ নেই তিনি সবকিছুর চরম পরিপূর্ণতা কিন্তুকল্লোলএসে আস্তে আস্তে সে ভাব কেটে যেতে লাগল বিদ্রোহের বহ্নিতে সবাই দেখতে পেলুম যেন নতুন পথ, নতুন পৃথিবী তবে, একথা ঠিক ‘কল্লোল’ পত্রিকা প্রকাশ হলে বাংলা সাহিত্যে নবযুগ আসার যে একটা রব উঠেছিল এই রবে রবীন্দ্রনাথ বিরক্ত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল এটি ভঙ্গি সর্বস্ব এবং ‘চাপরাশ পরা সাহিত্য’। একেই তিনি ‘সাহিত্যে নবত্ব’ প্রবন্ধে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘রিয়ালিটির কারি পাউডার’, ‘ধার করা ভঙ্গি’। মানুষের শরীর ঘেঁষা সংস্কার নিয়ে সাহিত্য রচনা তাঁর মতে ছিল সহজে বাহবা পাওয়ার কৌশল। এমন কথাই রবীন্দ্রনাথ আরো বিস্তারিত ভাবে বলেছেন ১৩৩৪ সালে প্রকাশিত ‘বিচিত্রা’ পত্রিকার শ্রাবণ সংখ্যায়, ‘সাহিত্যের ধর্ম’ প্রবন্ধে। 

‘কল্লোলে’র প্রতি সংখ্যার দাম ছিল চার আনা, পরে হয় পাঁচ আনা; বার্ষিক সডাক মূল্য সাড়ে তিন টাকা। পত্রিকার সাইজ প্রথমে ছিল ডিমাই। কিন্তু ছোট সাইজের জন্য বিজ্ঞাপন জুটত কম। ছোট সাইজের জন্য প্রথম শ্রেণীর পত্রিকা ‘প্রবাসী’ বা ‘ভারতবর্ষে’র মত আভিজাত্য বজায় থাকেনা মনে করে অনেক পাঠকের এটা মনঃপুত ছিল না। এসবের জন্য চতুর্থ বর্ষ থেকে ‘কল্লোল’ ডাবল ক্রাউন সাইজে পরিবর্তিত হয়। গোকুলচন্দ্রের মৃত্যুর পূর্বে দীনেশরঞ্জন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ‘কল্লোল’ তিনি চালিয়ে যাবেন। আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন তিনি। কিন্তু সপ্তম বর্ষে দীনেশরঞ্জন পত্রিকার মৃত্যু ঘোষনা করেন। সিদ্ধান্তটি হয় ত হঠাৎই নিয়েছিলেন তিনি; কারণ শেষ সংখ্যায় প্রকাশিত প্রবোধকুমার সান্যালের বড় গল্প ‘কাজললতা’র ভূমিকায় সম্পাদক লিখেছেন গল্পটি চৈত্র সংখ্যা পর্যন্ত চলবে, কিন্তু সেই মাসেই পত্রিকা বন্ধের সিদ্ধান্ত। দীনেশরঞ্জন লিখেছেন – এই কয় বৎসরে আমি এত ঋণজালে জড়িত হইয়া পড়িয়াছি যে, আমার পক্ষে একমাসও এখন কল্লোল চালান সাধ্যাতীত হইয়া পড়িয়াছে 

স্বাভাবিক কারণেই তিনি নিজেও অত্যন্ত ব্যাথিত হয়েছিলেন এবং তার আশা ছিল তিনি পত্রিকাটি আবার প্রকাশ করতে পারবেন, কিন্তু তার সে ইচ্ছা পূর্ণ হয় নি। সম্ভবত সব চেয়ে বেদনাহত হয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু। কিছুতেই তিনি সম্পাদকের এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি।তাঁর কথায় – “‘কল্লোলেরস্রোত যে তার পূর্ণতার সময়েই সহসা থেমে যাবে তা আমরা কেউ কল্পনা করিনিকল্লোলআর চলবে না খবর যেদিন শুনেছিলাম সেদিন মনে যে আঘাত পেয়েছিলাম তার রেশ এখন পর্যন্ত মন থেকে একেবারে মিলোয়নি 

রেশ না মেলালেও, শতবর্ষ পরে ‘কল্লোল’ কিন্তু রয়ে গেছে স্পর্ধিত অহংকারে – এটাই বা কম কিসে! 

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

Blog at WordPress.com.

Up ↑