এই পরবাস – পর্ব ১

অনিন্দিতা মণ্ডল 

​​​(১) 

স্নেহময় বিছানার একপ্রান্তে বসে ঋজু জানলার গরাদের বাইরে লেপটে থাকা ধূসর আকাশের গায়ে সবুজ গাছের আলপনা দেখছিলেন। একটু আগেই বৃষ্টি হয়ে গেছে। ধোয়া আকাশের গা থেকে মেঘ এখনও সরেনি। আম সুপুরি নারকেলের মাথা দুলিয়ে প্রাণের আনন্দ জানান দেওয়া থামেনি। মাঝে মাঝে স্নেহময়ের নিজেকে একটা ওরকম গাছ মনে হয়। যার পা দুটো মাটিতে গাঁথা অথচ শরীরটা মেলে রয়েছে আকাশে। দূরে জীর্ণ জুটমিলের পাঁচিলের গা ঘেঁষে খোলার চালের বসত। সেখানে নদী দূরে সরে গেছে। দক্ষিণে খানিক এগিয়ে স্নেহময়দের গলির প্রান্তেই চলে এসেছে নদী। যদিও মাঝগঙ্গায় চড়া পড়ছে। মাঝে মাঝে বকের ঝাঁক বসে থাকে। শামুকখোলের ঝাঁকও দেখা যায়। চরের গা ঘেঁষে জেলে নৌকো চলে। জুটমিল পোড়ো হলে কী হবে, পাঁচিলের গায়ে জীবনের অফুরন্ত স্পন্দন যেমন, তেমনই দেখা যায় জেটি থেকে পারাপারের লঞ্চ সচল। সকালবেলাটা তাঁর একান্ত নিজের।​ 

​​স্ত্রী স্বাতী এই ঘরে আর আসতে পারেন না বড় একটা। বাতে পঙ্গু পৃথুলা মানুষটা নীচে স্যাঁতস্যাঁতে একতলাতেই থাকেন। রোগের জন্য ভাল নয়। স্নেহময়েরও পায়ের জোর কমেছে। কিছুদিন হল বুকের জোর আরও কমেছে। ডাক্তার তাঁকে প্রায় ঘরবন্দী করেছেন। নীচে নামা সিঁড়ি ভাঙা বারণ। মাপা চলাফেরা। কয়েকদিন পর পর একবার নামছিলেন। ইদানিং মাঝে মাঝেই নামছেন। নিজের শক্তি যাচাই করতে ভাল লাগে। তিনতলার এই ঘরের লাগোয়া বাড়ির এজমালি ছাদে তিনি হাঁটতে পারেন। যে কেউ কিছু রোদে দিতে এলে তিনি সে সবের অলিখিত পাহারাদার। একমাত্র এই সকালেই তাঁর নিজস্ব মুক্তির সময়। চা আসবে আটটা বাজলে। সঙ্গে নিয়মের ওষুধ। ঘুমন্ত তাঁকে দেখে যায় পুত্রবধূ শ্রী। সে অনেক ভোরে। তারপর সে ব্যস্ত।​ 

​​ঝক্কির কাজ শেষ করে একেবারে চা জলখাবার নিয়ে হাজির হল শ্রী। স্নেহময় গল্প করেন। শ্রী তাঁর গল্প শুনতে ভালবাসে। নিজে যেচে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করে। আজ যেমন জানতে চাইল, “আচ্ছা বাবা? জুটমিলের ভেতরে আপনি কখনও গেছেন? ভিখুয়ার বাবা দুধ দিতে এসে বলছিল বুড়ো রামেকবাল নাকি শেষ লোক যে ওই মিলের পাঁচিলের ওপাশে গিয়েছে।” ​ 

​​স্নেহময় হাসেন, “ধুর! যাব না কেন? জুটমিলের পাঁচিল পেরিয়ে খেলাধুলো করা তো আমাদের ছেলেবেলার আমোদ! আর রামেকবাল বুড়ো শেষ গিয়েছে সে আবার কী কথা? ওই যে সীতা, ববিতা, মুন্নি সব কুঁচোগুলো রোজ তো পাঁচিল ডিঙিয়ে ওপাশে যায়! আম পেয়ারা পাড়ে। মাটিতে লতিয়ে ওঠা শাক তোলে, এমনকী আগাছা থেকে তেলাকুচোর ডগ কেটে আনে। তেলাকুচো ফল দেখেছ? পাকলে লাল লাল সুন্দর দেখতে হয়। মুন্নিদের ঘরের গায়ে মাথায় প্লাস্টিক দেওয়া টিয়াপাখির খাঁচায় ওরা তেলাকুচো ফল রাখে। টিয়া নাকি খেতে ভালবাসে।”​ 

​​শ্রী অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। স্নেহময়ের দৃষ্টিশক্তি আর স্মৃতি দুইই ঈর্ষা করার মত। “আপনি কোথা থেকে দেখতে পান?” স্নেহময় হাসেন, “কেন? ছাদে দাঁড়ালে সব দেখা যায় তো।”​ 

​​“কিন্তু রামেকবাল বুড়ো নাকি বলেছিল জুটমিলে মেমসাহেব মরে গিয়েছিল বলে কেউ আর ঢোকে না। মেমসাহেবের আত্মা ঘুরে বেড়ায়।” ​ 

​​হা হা করে হেসে ওঠেন স্নেহময়। পুত্রবধূর মুখের দিকে চেয়ে বলেন, “খাস কলকাতার মেয়ে হয়ে তুমি ভুতে বিশ্বাস করো? রামেকবাল নেশা করে কী বলতে কী বলেছে, ওর কথা কি ধরতে আছে? জুটমিলে যাদের দরকার তারা তো ঢুকবেই!”​ 

​​শ্রী নীচে যাবার সময় পইপই করে বলে গেল, “বাবা, বৃষ্টিতে ভিজবেন না। আজ আকাশ ছাড়বে বলে মনে হচ্ছে না। ভিজে শরীর খারাপ হলে কষ্ট পাবেন। আমি সেই একটা না বাজলে আসতে পারব না। দেবেন আসবে। যদি চান করেন তো ওকে বলবেন। এই জোলো হাওয়ায় চান না করাই ভাল অবশ্য।”​ 

​​স্নেহময় দেখেছেন শ্রীয়ের কথার মধ্যে প্রচ্ছন্ন হয়েও কোথাও আদেশ লুকিয়ে নেই। স্নেহময় যেন শিশু। এমন করেই কথা বলে। ছাদের দিকের দরজার কাছে একবার গেলেন। কিন্তু শ্রী মিশুকে। স্নেহময় জানেন। অথচ সকলে কত ভেবেছিল। শহরের মেয়ে। এখানে এসে কত দেমাক দেখাবে! কলকাতার কলেজে পড়তে গিয়ে দেখেছেন। মফস্বলি কুটিলতা খুব বোঝে না তারা। ছাদের মাথায় তিনটে মার্বেলের পরী এই বৃষ্টিতে ঝকঝকে হয়ে গেছে। অনেকদিনের ধুলোময়লা কালি ধুয়ে যেন নির্মল হয়ে গেছে তারা। পরীদের ডানাগুলোয় জলের ফোঁটা চিকচিক করছে। দেখলে মনে হবে ওরা যেন আরও ভিজতে চায়। পরীরা চাইলে ভিজতে পারে বৈকি! স্নেহময়ের ঠোঁটের পাশে এক চিলতে হাসি দেখা গেল। আবার দূরে উত্তরে দৃষ্টি মেললেন। পাঁচিলের ধারের বস্তিতে আজ বেশি কোলাহল নেই। বৃষ্টিতে ওদের বড় জ্বালা। ঘর তো পায়রার খোপ। ঘরকন্নার বেশিটাই এক দেয়ালে পাঁচিল ঘিরে। রান্নাবান্না ধোয়াকাচা সব ওখানেই রাস্তার ধারে। বাচ্চাদের স্নান খেলা সব। ঘরে শুধু ঘুমোতে যায় ওরা। ভীষণ গরমেও ওরা কিচিরমিচির করে বাঁচে। কিন্তু বর্ষা ওদের কষ্ট দেয়। খোলার চালের ঘরে জল পড়ে। বাইরে রাঁধাবাড়া কাপড় শুকনো সব বন্ধ। ঘরকন্না বন্ধ রেখে ওরা ঘরের চৌকিতে পা তুলে বসে থাকে। কচিত কখনও একটা দুটো কচি গলা পেলে তাকিয়ে দেখেন। সবাইকে চেনেন। কে এল বাদলে বাইরে? ওর মা নিশ্চয় কাজ সেরে ঘরে আসেনি এখনও। ওই সবিতা ওর ছেলেটাকে প্লাস্টিক আড়াল দিয়ে বসিয়েছে। স্নেহময় আন্দাজ করতে পারেন সবিতা কাজের বাড়ি থেকে আনা জলখাবার খেতে বসিয়েছে ছেলেটাকে।​ 

​​সায়ন যে স্কুলে পড়াশুনো করেছে এই বাচ্চাগুলোর বেশির ভাগ সেখানেই পড়ে। কিন্তু কী সব হচ্ছে আজকাল! স্কুলে লেখাপড়া নাকি হতে চায় না। স্নেহময় সেদিন শুনছিলেন মিলবস্তির মায়েদের কথা। বাবুদের মত লেখাপড়া আর শিখতে হবে না। বড় স্কুলে পড়াবার সাধ্য কী? আগে তো এই স্কুলেই কত ভাল লেখাপড়া হত। ইংরিজি তুলে দিয়েছে। ক্লাস ফোর পর্যন্ত পাশ ফেল নেই।​ 

​​স্নেহময় জানেন এরা উদ্ভট রকমের ভাবনা ভাবে। জীবনে আর কিছু নেই। তাই বিকট ভয়ের ভাবনাকেই এরা আপন করেছে। স্বস্তি চায় না ওরা। একটা অদ্ভুত ভীতিই ওদের জাগিয়ে রাখে। যেন বিদ্যুতের চাবুক। কষ্টে ভয়ে ওরা অনুভব করে যে ওরা জ্যান্ত। জীবনকে এইভাবেই অনুভব করতে পারে। নয়ত ওরা যে জ্যান্তেই মরে আছে।​ 

​​ভাবনার মধ্যেই ঘরে ফিরেছেন। শ্রী খুব কম তেলে চিঁড়ের পোলাও করতে পারে। সেটুকু খেয়ে ওষুধপত্র খেয়ে এইসব চিন্তাভাবনা আর ঘোরাঘুরির মধ্যেই কতকটা সময় কেটে গিয়েছে। ধীরে ধীরে জামাকাপড় বদলে বিছানায় এসে বসেছেন। দেবেন এলে আজ ফিরিয়ে দেবেন। এখন আর কারো স্পর্শ ভাল লাগে না। বিরক্ত হন, মুখে বলেন না।​ 

​​হঠাৎ মিলবস্তির থেকে চিল চিৎকার উঠল। ওদিকে বৃষ্টিও ঝেঁপে এসেছে। স্নেহময় জানলা দিয়ে মুখ বাড়ালেন। জলের ছাঁট আসছে। মেহগনির আলনাসহ বইয়ের আলমারিটায় ছাঁট লাগলে বিপদ। এক ঝলক দেখতে পেলেন লোকে গঙ্গার দিকে ছুটছে। হইহই কান্না আর গালিগালাজের আওয়াজের মধ্যেই তিনি শার্সি চেপে দিলেন। তারপর শার্সিতে মুখ চেপে দেখতে থাকলেন। জলে ধোয়া ছবি যেন। ওয়াশ পেন্টিং। লোকগুলোর মাথা আবছা হয়ে গেছে। অনেকগুলো মাথা জড়াজড়ি করে যেন একটা মাথা হয়ে গেছে।​ 

​​“বাবা? ঘরে জলের ছাঁট এসেছে? দেবেনটা দিন দিন বড্ড কুঁড়ে হচ্ছে। শার্সি চেপে দিয়ে যাবে তো। দেখি। এদিকে আসুন। জামা ভেজেনি তো?” স্নেহময় মাথা নাড়েন। ভেজেনি। তারপর শ্রীয়ের দিকে তাকান, “আজ রমেন্দ্রর কাছে যাওয়ার ছিল। অনেকদিন যাওয়া হয় না। কিন্তু এমন বৃষ্টি!” শ্রী খানিক চুপ করে থাকল। তারপর বলল, “বিকেলের দিকে বৃষ্টি কমে গেলে লালুকে বলা আছে, রিকশা করে চলে যাবেন। একা না যেতে পারলে দেবেন যাবে খন। যাওয়ার আগে বা ফিরে এসে মায়ের সঙ্গেও দুটো কথা বলবেন, কেমন?”​ 

​​স্নেহময় চুপ করে রইলেন। রমেন্দ্রর কাছে যাওয়ার আগে তিনি আর কারোর সঙ্গে দেখা করেন না। অনেকটা নিভৃতি বুকের মধ্যে না জমলে রমেন্দ্রর কাছে যাওয়া চলে না। ফিরে এসে বরং তৃপ্ত স্নেহময় বসতে পারবেন স্বাতীর কাছে।​ 

​​বিকেলে বৃষ্টি ধরার লক্ষণ দেখা গেল না। বরং আকাশ যেন ভেঙে পড়েছে মনে হল। ছাদের দিকের দরজার গোড়ায় দেবেন অনেকটা ন্যাকড়া গুঁজে দিয়েছে। নয়ত কলকল করে জল ঢুকে আসবে। পুরনো বাড়ির ছাদের ঢাল সবসময় নলের দিকে থাকে না। খোলা জলের ছলবলে গতি ঢাল না পেয়ে দরজা দিয়ে ঢুকে আসে। দেবেন জানলার খড়খড়ি শার্সি দুইই আটকে দিয়েছে। স্নেহময় একবার নীচে গিয়েছিলেন। কিন্তু একতলায় বেশিক্ষণ থাকতে পারেননি। উঠে এসেছেন ওপরে। স্বাতী কাতরাতে কাতরাতে পা ছড়িয়ে চৌকিতে কুটনো কাটছিলেন। পরের দিনের যোগাড়। তাঁকে দেখে বললেন, “পরিপাটি সেজেছ দেখছি। কিন্তু চারিদিক জলে জল।” স্নেহময় জানেন স্বাতী তাঁর সাজগোজ পছন্দ করেন না। অল্প বয়সে একরকম। এখন তাঁর এতটা বয়স হল তাও স্বাতী পালটালেন না। এখনও তিক্ততা ছড়িয়ে পড়ছে। তিনি গলা তুলে বলে এলেন, “লালু এলে ফিরিয়ে দিও।”​ 

​​দালানের কোনে সিঁড়িতে ওঠার মুখে কুলুঙ্গিতে টেলিফোন রাখা। তিনি ডায়াল করলেন। হোক বৃষ্টি। একদিন সব উপেক্ষা করেও তো গিয়েছেন। আজ যদি বৃষ্টি পথ রোধ করে তবে জানিয়ে দেওয়াটা প্রয়োজন। তিনি জানেন, রমেন্দ্র এসব জিনিস গুরুত্ব দেন।​ 

​​ওপরে উঠছেন, এমন সময় কিছু কথা যেন কানে এল। কে ভেসে গিয়েছে? কোথায়? আগে হলে খোঁজ করতেন। কিন্তু এখন আর ইচ্ছে হয় না। দেবেন বা শ্রী যে হোক খবর দেবে। সায়ন নয়। সে চায় না বাবা কিছু নিয়েই চিন্তা করুক।​ 

​​ইদানিং সিঁড়ি ভাঙতে হাঁপ ধরছে। বয়স বয়স। আরো কি কিছু মনের গভীরে আছে? স্নেহময় সেখানে ডুব দিতে চান না।​ 

​​খাটের এক পাশে পা গুটিয়ে বসেছেন স্নেহময়। তাঁর বসার ধরনটি অদ্ভুত। একটি পা ভাঁজ করা, অন্য পা’টি সেই পায়ের ওপরে তুলে হাত দিয়ে টেনে রাখা। বন্ধ ঘরে হলুদ আলোর নীচে বসে বসে মনে পড়তে থাকল,​ 

​​“কখনও তোমার ধানে মই আমি দিইনি আকাশ…”। এক টুকরো হাসি ভেসে উঠল মনের আকাশে।​ 

​​অনেক রাতে শুয়ে শুয়ে টের পেলেন সায়নের হাত। যেভাবে শিশুপুত্রকে পিতা আগলে রাখে ঠিক সেভাবেই সায়নের হাত তাঁর কপাল গাল গলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। বন্ধ চোখেও তিনি অনুভব করছেন, সায়নের দুটো চোখ আকুল চেয়ে আছে তাঁর দিকে। কী মায়া! তিনি সন্তর্পণে নিঃশ্বাস ফেলেন। জেগে আছেন বুঝতে পারলে সায়ন অপ্রস্তুত হবে। শুনতে পাচ্ছেন। পশ্চিমের জানলার খড়খড়ি খুলে দিচ্ছে সে। শার্সি ধীরে ধীরে বন্ধ করছে। বৃষ্টি থেমে গেছে। ছাদের দিকের জানলার শার্সি খুলে দিচ্ছে। নরম ঠাণ্ডা হাওয়া ভেসে এল। তিনি কি একটু কুঁকড়ে গেলেন? পায়ের কাছে ভাঁজ করা ভাগলপুরী চাদরটা গায়ে টেনে দিল সায়ন। সিঁড়ির মুখে ছোট আলো জ্বলে রইল। ভোরে শ্রী সে আলো নেভাবে। নিশ্চিন্তে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন স্নেহময়।​ 

(চলবে)… 

​​(স্নেহময়ের নিজের লেখা কবিতা ছাড়া বাকি কবিতা কবি রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরীর কিছু কবিতা থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে।) 

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

Blog at WordPress.com.

Up ↑