রাগরঞ্জনী – পর্ব ১ – দরবারী

রচনা – সম্বুদ্ধ চট্টোপাধ্যায়

হেমন্তের সন্ধ্যা। অস্তগামী সূর্যের লাল আভা ফতেপুর সিক্রির লাল পাথরকে শেষবারের মতন চুম্বন করল। আরক্ত লাল পাথরের অলিন্দে দাঁড়িয়ে যোধা ভাবতে লাগলেন, আজ তিন দিন হল জালাল-এর দেখা নেই। জালালুদ্দিন, ভারত সম্রাট আকবর, শিকারে গেছেন। হেমন্তের আগ্রা বড়ই রুক্ষ, বিধুর, ব্যাকুল। যোধার মনে যেন তারই প্রতিবিম্ব।
দূর থেকে আসা আওয়াজে যেন সম্বিত ফিরল যোধাবাঈ-এর।
হ্যাঁ, ঐ তো, শাহেনশা আসছেন। দূর থেকে মুঘল-পরচম উড়িয়ে, শতাধিক অশ্বারোহীর উন্মাদনার সঙ্গে।

বাঁদিদের সত্বর ডেকে নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করলেন যোধা। শম্মাদানের নরম আলো, ঝাড়বাতির বাহারি কাঁচের রঙের ছটা, মখমলি পর্দা আর গালচে-সাজানো খাসমহলে তিনি প্রতীক্ষারত।
চোখে সুরমার শেষ টান দিয়ে, কব্জিতে আতরের সুবাস নিয়ে চোখ তুলতেই দেখলেন জালাল এসেছেন তার খাস কামরায়। হ্যাঁ, তিনিই।

কিন্তু একি! মুখে ক্লান্তির ছাপ, চোখ দুটো হতাশা-ভরা। কোনদিন তো এমন হয় না! জালাল শিকার থেকে এলে জাশন বসে, দাসি-বাঁদিদের কোলাহল, সেতার-সানাই, আর ওস্তাদদের আলাপে মুখরিত হয় ফতেপুরসিক্রি। কিন্তু আজ…আজ সবকিছু যেন অন্যরকম।
সৌজন্যের কিছু নিয়মমাফিক কথা সেরে যোধামহল ত্যাগ করলেন মহামতি আকবর। আজ তাঁর মনে বেদনার দুর্ভেদ্য প্রলেপ। কিছুতেই যেন সহজ হতে পারছেন না। দরবার, পারিষদ আর নফর খোজার উপস্থিতি যেন তাঁকে আরো বিচলিত করছে।

“তখলিয়া” – শাহেনশাহর মুহূর্তের হুকুমে খালি হল দরবার কক্ষ। চিকন কাজের কিংখাব আর চন্দন সুবাসের ললিত মাদকতায় তানসেনের ডাক পড়ল।
নিভৃত আলাপচারিতায় মগ্ন জালাল আর তানসেন। একদিকে ভারতসম্রাট অন্যদিকে সুরসম্রাট।
কিছুক্ষণ পর সেজে উঠল অনুপ তালাব, শম্মাদানের আলো। জোড়া তানপুরার আওয়াজে মুখরিত হলো জালালের বিলাসকক্ষ।
কিন্তু একি! তানসেন মাথা নিচু করে বসে কেন? তবে কি আজ তার গানও শোনা হবে না? উন্মুক্ত তারকাখচিত আকাশ যেন প্রতীক্ষার শামিয়ানা টাঙিয়ে চুপ করে বসে আছে।
এক ফোঁটা চোখের জল মুক্তোর মত তানপুরার তারে ঝরে পড়লো। শুরু হল ধীরে, অতি বিলম্বিত আলাপ। লাল পাথরের প্রতিটি অলিন্দ, স্তম্ভ আর চবুতরার দীর্ঘলালিত ব্যথা ও অভিমানের যেন সুদীর্ঘ প্রতিসরণ। আলাপের দীর্ঘ মিড় ঋষভ ও মন্দ্র ধৈবত দিয়ে ছবি আঁকছে। কী অপূর্ব!

জালাল যেন দেখতে পেলেন আরো একবার। হ্যাঁ, আরো একবার।
শিকার করতে গিয়ে তিনি শরবিদ্ধ করেছিলেন একটি তিতির পাখিকে। তীরবেঁধা তিতির মাটিতে পড়ে ছটফট করছে। একটু একটু করে তার প্রাণবায়ু বেরিয়ে আসছে। শেষবারের মতন শরীরে হালকা কম্পন তুলে নিথর হল তিতির। এরপরই ঘটল এক আশ্চর্য ঘটনা। কোথায় ছিল তার সাথী, উড়ে এসে মৃত তিতিরকে বৃত্তাকার প্রদক্ষিণ করতে লাগল। পাখিটির সকরুণ হাহাকার, আর্তনাদ আর ক্রন্দনধ্বনি আকবরের হৃদয়কে ক্রমশ অবশ করে তুলল। মৃত সঙ্গীকে প্রদক্ষিণরত অন্য তিতিরটির সেই কান্না যেন তিনি আবার শুনতে পাচ্ছেন, তানসেনের গানে।

হ্যাঁ, ঠিক তাই। কোমল গান্ধার ও কোমল নিষাদের মোচড় যেন সাথীহারা পাখির হাহাকারের প্রতিবিম্ব। সুর ভুলিয়ে দিচ্ছে দুঃখ। শান্তির প্রলেপ ফেলছে বেদনায়।
ধীরে ধীরে জোড় আলাপে উপনীত হল রাগ। কোমল ধৈবত পঞ্চমে নেমে আসছে কোমল নিষাদ ছুঁয়ে। সুর যেন তার রাজকীয় দাঢ্য ছেড়ে ফকির দরবেশের রূপ ধারণ করেছে। রক্তিম গরিমা যেন ত্যাগের গেরুয়া। মহামতির চোখ ঝাপসা, নোনা জলের জোয়ার চোখের সুর্মার কলুষকে ধুয়ে দিয়ে যাচ্ছে। সব চুপ। শুধু সুরের বৈরাগ্য, আর কিছু নেই।
গান শেষ হল। আকবরকে কুর্নিশ জানালেন তানসেন। আরক্ত চোখের জল মুছে জালালউদ্দিন নিজের কাছে ডাকলেন তাঁর সভারত্নকে। তাঁর মন এখন অনেক হালকা। সম্ভ্রমভরে করচুম্বন করে আলিঙ্গন করলেন তানসেনকে। জিজ্ঞাসা করলেন, “এ কোন রাগ গাইলে বন্ধু যাতে অশান্ত মনে শান্তি এল?”

মন্দ্রমধুর কন্ঠে সুরসাধকের উত্তর, “শাহেনশা, এই রাগের সঙ্গে আপনার দরবারের নাম জড়িয়ে থাকবে চিরকাল। আপনারই জন্য তৈরী করলাম, রাগ দরবারী।”

ডিস্ক্লেমার – এটি একটি ইতিহাস-আশ্রিত রচনা।


এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

Blog at WordPress.com.

Up ↑