অনিন্দিতা মণ্ডল
(৩)
সকাল হল অনেকটা সোনালি রোদ্দুর নিয়ে। গত সন্ধের ওরকম বৃষ্টি কোথাও তার ছাপ রাখল না। শুধু বাড়ির পেছনের ঘন ঝোপ যেন আরও একটু সবুজ হয়ে দেখা দিল। এক সন্ধেতেই যেন কিশোরী আগাছা লতার দল তরতরিয়ে বেড়ে গেল। সামনে জানলা দিয়ে যে রোজকার ঘরকন্না দেখা যায় সেদিকে তাকিয়ে স্নেহময় সেই এক যাপনের পুনরাবৃত্তিই দেখতে পান। স্বস্তি বোধ করেন। সমানতালে সব কিছু ছুটে চলেছে যেন। অস্থিরতাই ধর্ম। তার মাঝে এমন পুনরাবৃত্তি তাঁকে আরাম দেয়। শাশ্বত জীবন যেন। রেললাইনের ওপার থেকে বন্ধু বীতশোক আসেন মাঝে মাঝে। কলেজে একসঙ্গে পড়াশুনো করতেন। তারপর বীতশোক কর্মসূত্রে ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে ঘুরে বেরিয়েছেন। আজ দশটা বছর অবসর জীবনে দুজনে আবার কাছাকাছি এসেছেন। আর কী আশ্চর্য! স্নেহময় দেখেছেন এখন তাঁরা যেন আরও বেশি বন্ধু। ছেলেবেলার নানা পার্থক্য উধাও হয়ে দুজনে বড় কাছাকাছি এসেছেন। আজ কি বীতশোক আসবে বলেছিল? মনে পড়ছে না। কিন্তু এরকম দিনক্ষণ বেঁধে তাদের বন্ধুত্বও তো নয়। আসলে আড্ডা হবে।
সিঁড়িতে পায়ের শব্দে ফিরে চাইলেন স্নেহময়। দেবেন এসেছে জলখাবার নিয়ে। শ্রী কি ব্যস্ত? একবার এসময় আসেই। দেবেনকে জিজ্ঞেস করলেন, “”শ্রী? দেবেন মুখ নীচু করে খাবার দিচ্ছিল। নীচু গলাতে বলল, “আজ আরতিদি আসবে না। ওদের কে যেন কাল গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়েছে।” “কে?” স্নেহময় জানেন দেবেন তাঁকে নামটা বলছে না। কিন্তু তিনি স্থির চেয়ে রইলেন। অগত্যা দেবেন বলল, “মুন্নির নতুন বউদি।” হতবাক হয়ে গেলেন স্নেহময়। সে কী? ওইটুকু মেয়ে! কদিন আগেই তো দেহাত থেকে এল। বিয়ে হয়ে এখানে এল। ছোট্ট মেয়ে। কত বা বয়স! ষোল হবে? সে কেন গঙ্গায় ঝাঁপ দিল? স্নেহময় জিজ্ঞেস করলেন, “কেন রে?” দেবেন উত্তর দিল না।
সারাটা বেলা বড় বিমর্ষ হয়ে রইলেন। এইটুকু মেয়ে! কী হল যে। বেলা বাড়লে গলিতে পুলিশের আনাগোনা দেখা গেল। আর ঠিক তখনই ছাদে একটা দুটো করে পরিবারের সবাই আসতে শুরু করল। ঠাকুরদাদের আর অন্যান্য ভাইয়ের পরিবার সব আসতে শুরু করেছে। ছাদে ছাদে আনাগোনা করা যায়। কিন্তু এটা কি মজার ঘটনা? একটা ছোট্ট মেয়ে কোন দুঃখে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়েছে কে জানে? কেউ সেকথা ভাবল না। এখন ভিড় করেছে মজা দেখতে। মজাই তো! নিস্তরঙ্গ জীবনে একটু উত্তেজনা। দোষারোপ।
ইতিমধ্যে স্নেহময় গলির দিকের জানলা ভেজিয়ে দিয়েছেন। ছাদের দরজাও। ছাদ থেকে ভেসে আসছে সেজর ছেলের গলা। গোপাল। অকম্মার ঢেঁকি একখানা। এখন সেও কিছু বলছে। এই কুৎসিত কথাবার্তা তাঁর ভাল লাগছে না।
তিনি সিঁড়ি দিয়ে মুখ বাড়িয়ে নীচে তাকালেন। গলা তুলে ডাকলেন, “শ্রী?” সাড়া ভেসে এল। স্বাতীর যা ছুঁচিবাই স্বভাব! আরতি না এলে শ্রী যে বিপদে পড়ে তা তিনি জানেন। শ্রী এল ওপরে। ক্লান্তি চুঁইয়ে পড়ছে চোখেমুখে। তবু তার চোখে কষ্ট পড়া যাচ্ছে। স্নেহময় চুপ করে রইলেন। শ্রী বিছানার একপ্রান্তে ধপ করে বসে পড়ল।
“বাবা, জানেন, মুন্নির ওই ছোট্ট বউদিটা, ঊর্মিলা, গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়েছে কাল। অত বৃষ্টিতে ওকে কেউ খুঁজে পায়নি। ও নাকি এখানকার কারো ভাষা বোঝে না। রীতিনীতি জানে না। তাই নিয়ে নিত্য অশান্তি। ওর শাশুড়ি খুব রাগী। রোজ মার খায় মেয়েটা। কিন্তু তাতেও ওর মুখে হাসি ছিল। কিন্তু কাল কী হল কেউ জানে না। পুলিশ বলছে ওকে জ্যান্ত পেলে তো ভাল, না হলে বাড়িশুদ্ধু লোককে থানায় নেবে।”
“কেউ জানে না একথা ঠিক নয়। মুন্নির দাদা নিশ্চয় জানবে, তাই না? কী যেন ওর নামটা?”
“বুধিয়া? ও তো কেমন হাবাগোবা ধরনের। ও কিছু বোঝেই না। জানবে কি?”
“তাহলে মুন্নির বউদি ঘর করল কী করে?”
“মুন্নির মা ওপারে শীতলার ভর হয় যে, সেখানে যায়। বউকে বলেছিল, বুধিয়া ভাল হয়ে যাবে। বউটা তো ছেলেমানুষ।”
স্নেহময় চুপ করে গেলেন। শ্রীর রাজ্যের কাজ আছে এখন। ছাদের সমাবেশে ওর যাবার সময় নেই। সেজ বউদির গলা পাচ্ছেন। কাকে যেন বলছেন, “ছোটলোকের ব্যাপার সব। ওতে মাথা দিয়ে সময় নষ্ট। আমাকে ধর বাবা। নামি। সিঁড়ি তো নয়, যেন স্বর্গের সিঁড়ি।”
বিকেলে জানলা খুলে দিয়ে গেল দেবেন। স্নেহময় দুপুরে কিছু খাননি। শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে বলেছিলেন। একবেলা উপোস দিলে ঝরঝরে হয়ে যাবে। স্বাতী নীচে গজগজ করেছেন। ‘অত বৃষ্টি! জানলা দরজা খুলে শোভা দেখা হচ্ছে। বলিহারি যাই! ভিজে হাওয়া সহ্য করার বয়স আছে আর?’
সন্ধেবেলায় শুয়ে আছেন। সায়ন এল। এমন সময় তিনি সাধারণত বই পড়েন। শুয়ে থাকেন না। সায়ন বলল, “আপনার জ্বর এসেছে নাকি?” মাথা নাড়লেন, নাঃ। “তাহলে?” সায়ন চেয়ারে বসে রইল। স্নেহময় জানেন সায়ন বসে বসে ওঁকে বুঝে নিতে চাইছে। ভাষা দিয়ে, শব্দ দিয়ে নয়। এক অদ্ভুত পথে সে বুঝে নেয় তাঁকে। তিনিও বুঝে নেন। টেলিপ্যাথি? কিন্তু আর কারোর সঙ্গে এমন যোগাযোগ হয় না তো? আত্মজ? হয় যে না সে তো দেখাই গেল। মুন্নির বউদি ভাষা বুঝত না। তাই কেউ জানতেই পারল না কেন গঙ্গায় ঝাঁপ দিল।
“বাবা। এবেলা কিছু খান। দুর্বল হয়ে পড়বেন। মুন্নির বউদি মরে বেঁচে গেছে। ওকে নিয়ে দুঃখ পাবেন না।”
যেন বিদ্যুতের চমক লাগল। বেঁচে গেছে? এই জীবন থেকে চলে গিয়ে বেঁচে গেছে? এতটুকু মেয়েটা বাঁচার মানে কীরকম করে জানল? তাঁর দুঃখ গেল না। তবু সায়নের মুখের দিকে চেয়ে বললেন, “আজ নীচে গিয়ে খাব।”
(চলবে)…
(স্নেহময়ের নিজের লেখা কবিতা ছাড়া বাকি কবিতা কবি রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরীর কিছু কবিতা থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে।)




এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান