প্রতিমা রায়
বাবা হওয়া বড় আনন্দের, কিন্তু সবসময় গৌরবের নয়।
আমি অবশ্য সমুদ্র মন্থনের পর উত্থিত তীব্র হলাহল পান করে নীলকন্ঠ রূপ ধারণ করেছি, এখন পৃথিবীর কোনো আনন্দ বিষাদ আর আমায় স্পর্শ করে না।
ব্যাপারটা খুলেই বলি – আমার মেয়ে পুনম। আমার বড় আদরের। কন্যাসন্তান বলে আদর যেন একটু বেশিই। তাছাড়া আমি কন্যাসন্তানই চেয়েছিলাম। প্রজাপতির মত আমার মেয়ের বড় হওয়া দেখতে দেখতে আমার প্রথম বাবাবেলা বেশ কেটে যাচ্ছিল। আমার দিদি মনোরমা তা দেখে ছদ্মরাগে বলত – “খায় দায় পাখিটি/ বনের দিকে আঁখিটি। যতই ভালবাসা পাক, মেয়েদের মন পরের বাড়ির দিকে। মেয়েসন্তান, বেশি মায়া বাড়াস না সঞ্জু, পরে কষ্ট পাবি।”
আমি হা হা করে হাসতাম। কথাটার বিষাদ তখন তো আমাকে ছোঁয়ার সাহস পায়নি। কেননা তখনই যে দুটো কচি হাত আমাকে এসে ছুঁয়ে বলত – “বাবা, তুমি ঘোড়া হও, না তুমি গাড়ি, না, না, উড়োজাহাজ। না, আজ কু ঝিক ঝিক ট্রেন।” আর একটু বড় হয়ে – ” বাবা আমাকে ট্রেন দেখাতে নিয়ে যাবে, নীল ট্রেন। যে ট্রেন হুস করে চলে যায়।”
আমার ভয় হত, খুব। নীল ট্রেন তো দূরপাল্লার যাত্রীর। আমি বলতাম – “দূরে কেন মা!” তখনই খিলখিল করে হেসে বলত – “বাবা, আমাকে লাল বেলুন কিনে দেবে, না না বাবা একটা সাজুগুজু করা পুতুল নেব, চোখ টানা টানা চুলে বিনুনি, ওমনি করে চুল বেঁধে আমি খেলব, হি হি।”
সারা ঘরে আনন্দ খেলে বেড়াত। সে আনন্দের নানা রঙ – কখনো প্রথম সূর্যের আলোর, কখনো মধ্যাহ্ন সূর্যের তো কখনো অস্তমিত সূর্যের। খেলতে খেলতে একটু চোট আঘাত লাগলে মনে হতো এ চোট আমার লাগল না কেন?
আমার বার্বি ডল, আমার আদরের আত্মজা – পুনম। সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত শরীরটা এক নিমেষে ঝলমল করে উঠত, যখন কচি গলায় ডাক আসত – ‘বা-বা’।
সুখের দিন বড্ড তাড়াতাড়ি বোধহয় কেটে যায়! যেদিন আমার বাড়িতে গোলাপী রঙের সামনে বাস্কেট দেওয়া লেডিবার্ড সাইকেলটা এল, খুশিতে আমাকে দেখিয়ে সাইকেলে চড়ে একপাক দিয়ে এল পুনম। তা দেখে পাড়ার রকে ফিসফিসিয়ে শব্দ উঠল – ‘পাপা কি পরী।’ বুকটা কেমন চিনচিন করে উঠল। ছোট্ট চারাগাছে বেড়া দেওয়ার মত, সেই প্রথম তার চারপাশে তুলে দিলাম অদৃশ্য সুরক্ষা বলয়। এখানে ওখানে যাতায়াতে নিষেধ আরোপিত না হলেও পুনমের সঙ্গে তার মা বা মনোরমাদিই বেশির ভাগ সময় থাকত। সময় হলে আমি। কখনও কোথা থেকে ফিরতে দেরি হলে চিন্তার পাহাড় জমে যেত।
আরো কিছুদিন এভাবে। তারপর মনোরমাদিই প্রথম কথাটা তুললে – “এবার একটা পাত্রের সন্ধান করতে হবে সঞ্জু, পুনম ক’দিন পরে বি এ পাশ করবে।” গিন্নিও মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। চমকে উঠলাম আমি। সেই ছোট্ট পুনম বড় হয়ে গেল! সত্যিই তো সেই কচি হাত দুটো এখন আর গলা জড়িয়ে আবদার করে না। দিদির কথাই ঠিক, আমার মেয়ে আমাকে ছেড়ে সত্যিই পরের বাড়িতে…
দুই
না, আমি বিয়ে দিইনি পুনমের। পুনম নিয়ে এল অভিষেককে। আমার ঝকঝকে পুনমের পাশে উজ্জ্বল শ্যামল বর্ণ, মাঝারি গড়নের, উজ্জ্বল চোখের এক যুবক। নেহাতই এক সাদামাটা বলা যায়। বেসরকারি একটা চাকরি করে, তাও বলার মত নয়। আমার মেয়ের পছন্দ, আমি মাথা নেড়ে সম্মতি না জানলেও অসম্মতিও জানালাম না। আমি তো অমরীশ পুরী টাইপের বাবা নই। তখনও বিস্ময়ের পালা শুরু হয়নি।
পুনম বলল – “বাবা, আমি অভিষেকের সঙ্গে একসঙ্গে থাকতে চাই ।”
- “মানে!”
- “মানে আর কী? আমি আর অভিষেক একসঙ্গে থাকব।”
মনোরমাদি চিৎকার করে উঠল – “শুধু একসঙ্গে! বিয়ে করে নয়, মানে তো লিভ টুগেদার। কী বলছ? বিয়ে নয় কেন?”
উত্তরটা এমনভাবে এসেছিল যেন একটা বুলেট কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। পুনম অত্যন্ত ধীরে অথচ দৃঢ় স্বরে জানাল – “অভিষেক ক্যান্সার আক্রান্ত তাই।”
ক্যান্সার! মারণ ব্যাধি! এ শব্দগুলো কথা হয়ে কানের কাছে ঘুলিয়ে ঘুলিয়ে উঠল। কান থেকে বুকে। আমার চিন্তাভাবনায় কুষ্ঠরোগ ছড়িয়ে পড়ল। ক্যান্সার কী,, কেন কিওরেব্যাল কিনা, এসব ভাবনায় রাহুগ্রাস করল। শুধু ভাবলাম আমার আদরের পুনম একটা ক্যান্সার আক্রান্ত ছেলের সঙ্গে থাকবে? আমার বাবা সত্তা কীভাবে সায় দেবে? কোন বাবা তা মেনে নিতে পারে? সেই প্রথম আমি চিৎকার করেছিলাম। মাথা গরম করে মেয়েকে শাসন করেছিলাম, হয়তো কটুবাক্যও কিছু শুনিয়েছি।
মেয়ে আমার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল, কিছু বলেনি। হয়ত ভেতরে ভেতরে কষ্ট পেয়েছিল।
মাথা ঠাণ্ডা হতে, পরে ভাল করে বুঝিয়ে ছিলাম – “এসব ফিল্মে হয়, মা। জীবনটা ফিল্মি নয়।”
বাবা হয়ে মেয়ের কথা ভাবতে গিয়ে একটু স্বার্থপর হয়ে গেলাম, অভিষেককে কোন সহানুভূতি দেখানোর কথা মাথাতেই আসেনি।
প্রত্যাঘাতটা এসেছিল। অত্যন্ত নিষ্ঠুর ভাবে। পুনম পরের দিন বাড়ি থেকে পালিয়ে গেল। সবার অজান্তে ভোরের আলো ফোটার আগে কিংবা ভোরের আলো ফুটিয়ে।
স্তব্ধতা নেমে এল চারপাশে। ঘরের ভেতরে, মেঝেতে সিঁড়িতে সিলিং থেকে ছাদে সব জায়গায় । যেন বাজ পড়েছে। তার আগুনের হলকায় আমরা সবাই ঝলসে গিয়েছি। বাজটা আমাদের মনের ভেতর ঢুকে ফালাফালা করে বেরিয়ে গেছে।
তিন
না, আমি থানা পুলিশ কিছু করিনি। কারণ আমার মেয়ে প্রাপ্তবয়স্কা। এসব ঝুট ঝামেলা আমি চাইনি। তাছাড়া থানায় গিয়ে কী বলতাম? সব জেনেবুঝে মেয়ের ফটো বুকে সাঁটিয়ে নিয়ে গিয়ে বলতাম – “আমার মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, খুঁজে দিন স্যার!” যে স্বেচ্ছায় যায়…। জাগ্রত মানুষকে ঘুম থেকে টেনে তোলার আবার মানে কী! মনের ভেতর কেমন একটা অভিমান যেন আমাকে শক্ত পাথর বানিয়ে দিল।
পুনম চলে যাওয়ার দু’সপ্তাহ পর নিজেকে সামলে অফিসে গেলাম। আশংকাটা ছিলই, সেটাই সত্যি হল। সহকর্মীরা অনেকেই আমার মুখের দিকে দেখছে। জানি কথা চাপা নেই। পরের বাড়ির স্ক্যান্ডাল তাড়াতাড়ি ছড়ায়। আমাদের বাড়ির দু’তিন বাড়ি পরে বক্সীদাদের বাড়ি, উনিই আগে ফোন করেছিলেন। তারপর আমার ডিপার্টমেন্ট কলিগরা। ঘর থেকে সোমত্ত পালিয়ে যাওয়া মেয়ের বাবা আমি, এক ধরনের সহানুভূতি আমার প্রাপ্য। আমি এতদিনের জমা ধূলো ঝেড়ে আমার চেয়ারে বসতেই আমার সামনে চেয়ারের পাশে এসে দাঁড়ায় বুদ্ধদা, বিপ্রতীপ, অনুপ কল্লোল আরো অনেকে। বুদ্ধদাই প্রথম বললে – “ঠিক আছ, সঞ্জয়?”
আমি মাথা নাড়ি।
এই ছোট্ট উত্তরে সবাই সন্তুষ্ট নয়। আর সন্তুষ্ট কেনই বা হবে, যখন কথা বলার ময়দান উন্মুক্ত হয়ে গেছে! অনুপ নখ খুঁটছিল, যেন মনে মনে প্রশ্নগুলো গুছিয়ে নিচ্ছিল। তারপর শুরু করে এভাবে -” আর বৌদি?”
একইভাবে মাথা নেড়ে জানাই – “হাঁ।”
- “এ কদিন ধরে চাপটা তো তাঁর উপরই বেশি। আফটার অল মা না। আচ্ছা বৌদি আগে থেকে কিছু জানতে পারেননি ছেলেটার ব্যাপারে? না, মানে মায়েরা তো সন্তানের অনেক কিছু আগাম আঁচ করতে পারে।”
তীরের অভিমুখ কোনদিকে আন্দাজ করতে পারি, তবু ঘাড় নেড়ে উত্তর দিই – “না না।”
উল্টো দিক থেকে কল্লোল -“কীভাবে আলাপ ছেলেটার সঙ্গে? বাড়িতে আগে এসেছে? ফ্রেন্ড সার্কেলে ছিল? পুনমের কি ছেলে বন্ধু বেশি ছিল?”
আমার মাথা ঘুরছিল, মেয়েকে ভালবাসি সব বাবার মতো, তা বলে তার পায়ে বেড়ি পরিয়ে দেব এমন তো কখনো ভাবিনি। উঠে হাত মুখ ধুতে ওয়াশরুমে গেলাম। আমার স্ত্রী, মনোরমাদির মুখ মনে পড়ল। খাওয়া দাওয়া তেমন করে বাড়িতে আর হচ্ছে কই। রান্না হচ্ছে কবেও হচ্ছে না, হলেও খাবার সেভাবেই পড়ে থাকছে। আমাদের মনের ক্ষতের ঘাতে এখনও কিলবিল করছে শোক পোকা। কীভাবে সামলাব! তার উপর মেয়েটাকে যে কতদিন দেখিনি। প্রাণটা আছে এই পর্যন্ত ।
লাঞ্চে আবার ফিরে এল ওরা। আমার টিফিন বক্সে কেবল শুকনো মুড়ি। তাও মুখে তোলার ইচ্ছে নেই। অনুপ খুব সমঝদার ছেলে, বক্স খুলে লুচিতে কামড় বসিয়ে বললে – “আজকের জেনারেশন এতটা আবেগপ্রবণ নয়, নিজেদেরটা ভাল গোছাতে জানে, সেখানে পুনম ওরকম একটা ছেলেকে! একেবারে ফুলিশ।”
আমিও কি মনে মনে বললাম “ফুলিশ, ফুলিশ?”
তখনই বারীনদা এসে গেল। আমার একেবারে সামনের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে বললে – “মেয়ে পালিয়ে গেছে, তো কী হয়েছে? মেয়েকে বুঝিয়ে বাড়িতে নিয়ে এসো, ওরকম আকছার হচ্ছে।”
বিপ্রতীপ যাকে বেশ আমারা বেশ বুদ্ধিমান নম্র বলে জানি, সে বললে – “কোনো ইস্যু টিস্যু আসলেও হসপিটালে খালাস করে দেবেন। আরে প্রেম বলে তো কিছু নেই, আসলে সবই হরমোনের খেলা। এই বয়সে তা একটু বাড়াবাড়ি রকমের সক্রিয় থাকে এই যা।”
বুদ্ধদা একটু ঘুরিয়ে উপদেশ দিলেন – “আমাদের ফ্ল্যাটের ভদ্রলোকের মেয়ের পেটে তিনমাসের ইস্যু ছিল, শাঁখা সিদূঁর মুছিয়ে পাপ বিদেয় করে ঘরে এনে, কিছুদিন পরে ভাল ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলে। এখন দিব্যি আছে। আজকাল কত কলেজ পড়ুয়া মেয়ে হোটেল-বারে কাজ করে হাতখরচ চালায়। বিয়ের আগে দীঘা পুরীতে হোটেলে রাত কাটিয়ে ফষ্টিনষ্টি করে, তারপর বাড়ির মতে ভাল ছেলের গলায় ঝুলে পড়ে।”
অনুপ মাথা নেড়ে সায় দেয়।
কল্লোল বলে – “কিছুদিন একটু মন খারাপ থাকবে, তারপর নিউ অন, ওল্ড গন।”
শুধু সীমাদি আমাদের সিনিয়র অফিসার সিঁড়ির মুখে ওনার সঙ্গে দেখা হতে বললেন – “,সঞ্জয় মেয়েটার মনটা তো বোঝ।”
আমার অস্বস্তি লাগে, তবু সবার মুখের দিকে দেখি, সবার মতামত শুনি। আমি আজ হেরে যাওয়া এক বাবা, জীবনের কাছে সবার কাছে।
এরকম আলোচনা অবশ্য আগেও অফিসে বুদ্ধদারা করেছেন ঠিকই, রাস্তাঘাটের আশপাশের ঘটনা নিয়ে- এসব নতুন নয়। নতুন কেবল আমি, আর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আমি, আমার মেয়ে। আমার মেয়ে পালিয়ে গেছে, আমি কোথায় পালাব? কোথায় মুখ লুকোবো। সমাজ থেকে পালানোর রাস্তা কোনদিকে? মনে মনে খারাপ কামনা করি অভিষেকের, একবারও আমার বা আমাদের মনে আসে না ছেলেটা ক্যান্সার আক্রান্ত। কেন আসবে? অভিষেকের জন্য আমার মেয়ে ঘর ছেড়েছে, ও দোষী দোষী। দোষীর কি সহানুভূতি প্রাপ্য?
মাথা নীচু করে বাড়ি ফিরি, আমার মেয়ে যেভাবে স্বেচ্ছায় জীবন বেছে নিয়েছে, সেভাবে আমি মাথা ঝুঁকিয়ে থাকি। সন্ধ্যা নামে, পাখিদের ঘরে ফেরা দেখি। ঘরে ফেরা দেখতে আমার ভাল লাগে।
চার
একটা বছর কোথা থেকে কেটে গেল। মন বুঝতে, মনের বর্ষাপ্লাবিত নদীতে সেতুর অস্তিত্ব খুঁজতে গিয়ে দেখি ছেঁড়া খোঁড়া সেতুটার ওপর যান চলাচল নিষেধ বলে – একটা মস্ত বোর্ড ঝোলানো, তাই সেতু পার হতে পারিনি, এ পারে বসে এখন সময়, সময়ের বহমানতা দেখতে থাকি। সময়ের হাতে সব কিছু সমর্পণও করেছি। এছাড়া আমার বা আমাদের আর কীই বা করার আছে। এতদিনে কান্না লুকানোও রপ্ত করে ফেলেছি। বুকের ভেতর চিনচিন করলে অন্যমনস্ক হবার চেষ্টা করি।
আমাদের জীবনযাত্রা আগের মত না থাকলেও ধীরে ধীরে ধাতস্থ হচ্ছি। অনেকদিন পর সকালে উঠে খবরে কাগজ হাতে নিয়েছি, এবার পাতা উল্টাবো আনমনে। হয়তো চা-ও মুখে তুলব। সকাল বয়ে যাবে, স্নান সেরে রেডি হবো অফিসে যাওয়ার জন্য, তখনই হঠাৎ বাড়িতে পুলিশ এল। আমি সমেত বাড়ির সকলে বেশ আশ্চর্যই হলাম।
পুলিশের আসার নানা সাত পাঁচ কারণের আবর্তে ঘুরপাক খেতে লাগলাম।
ওঁরা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে সরাসরি জানতে চাইলেন – “সঞ্জয় মহাপাত্র কে?”
উত্তর দিলাম – “আমি।”
- “আপনিই কি পুনমের…?”
এবার মনের ভেতরের সব অস্থিরতাকে একটা কালো গহ্বরে ঢেকে বললাম – “হাঁ আমিই পুনমের বাবা।”
মাথা ঝুঁকে যায় ।
- “আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে।”
কোথায়? অস্ফুটে বললাম বোধহয় – “কেন?”
- “থার্টি টু বাই ফোর, বি সি রয় রোড, সেকেন্ড ফ্লোর অতিথি অ্যাপার্টমেন্ট, শ্যামনগর । ওখানে গেলে জানতে পারবেন।”
ওখানে! ভেতরে ভেতরে আশা আকাঙ্ক্ষাগুলো ঝুলনের দোলনার মতো দোল খাচ্ছে। তারচেয়ে পা এগোতে পারছিল অনেকটাই কম গতিতে।
পৌঁছানোর আগে থেকে একটা গন্ধ এসে নাকে লাগছিল, টের পাচ্ছিলাম। এ গন্ধ সুগন্ধ বা দুর্গন্ধের নয়, এ গন্ধ আমার অনাঘ্রাত, আমার অতীত। কিন্তু সঙ্গী পুলিশদের জিজ্ঞাসাও করতে পারছি না, হয়ত পুলিশ বলেই।
পুলিশ কিন্তু যথেষ্টই মানবিক ব্যবহার করছিল। প্রথমেই সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় গেলাম তাদের সঙ্গে। পুলিশরাই দরজা খুলে দিলে। তাদের অনুসরণ করতে লাগলাম। সামনে ড্রয়িং কাম ডাইনিংরুম, তারপর কয়েক পা হেঁটে বেডরুম। কিন্তু আমি যেন অনন্ত পথ চলেছি। কখন যে এ পথ শেষ হবে, হাঁপিয়ে উঠেছি। ঐ ঐ তখনও সারা ঘরে ফুলস্পিডে এসি চলছে। কী দারুণ ঠান্ডা! কাঁপুনি লাগছে। আমাকে বেশ কেয়ার করে এগিয়ে নিয়ে চললে, বেডরুমে এসে চলা থেমে গেল। তারপর ধীরে ধীরে খাটের কম্বলের ঢাকা তুলে দিলে। বেরিয়ে এল দুটি দেহ, পাশাপাশি শুয়ে। অনন্ত ঘুমে শুয়ে পড়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। তাদের সেই ফ্যাকাশে মুখ দুটিতে ছড়িয়ে পড়েছে স্বর্গীয় শান্তি।
এতক্ষণের আমি এবার স্থবির, হাতে পায়ে নেমে আসছে তরল হিমশীতলতা। চোখের সামনে কালো পর্দা নামছে, চোখের চশমাটা নামিয়ে কোনোক্রমে মুখে উচ্চারণ করতে পারলাম — “মা আমার!”
পাঁচ
মনে নেই আর কিছু মনে নেই, সম্বিত ফিরতে জানলাম – মৃত্যুর খবর থানায় মেইল করে পুনম অভিষেক আগে থেকে জানিয়ে দিয়েছিল। সেইমত পুলিশ ঠিকানা খুঁজে চলেও আসে, কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। ওরা আরো জানিয়ে গেছে – ওদের মৃত্যু নিয়ে কোনোরকম হইচই যেন না হয়। ওরা স্বেচ্ছায় চলে যাচ্ছে। মেসেজ ছিল আমার জন্যও। পুনম লিখেছে – “ক্ষমা করো বাবা, অভিষেককে ছেড়ে যেতে পারিনি, তোমারও বিড়ম্বনার কারণ হতে চায়নি। তুমি ভাল থেকো বাবা।”
ওদের বন্ধুরা বলাবলি করছিল – শেষটায় নিদারুণ কষ্ট পেয়েছে অভিষেক। ওর বাবা মা কেউ নেই। এক দিদি এক বছর আগে ক্যান্সারে মারা গেছে। এক বছর আগে অভিষেকেরও ক্যান্সার ধরা পড়ে। চাকরিতে প্রায় অনিয়মিত হয়ে পড়ছিল অভিষেক, পুনম সামাল দিতে একটা বিউটি পার্লারে কাজ নেয়। মুম্বই পর্যন্ত নিয়ে যায় অভিষেককে চিকিৎসা করাতে। কিন্তু ধীরে ধীরে ওদের পুঁজি শেষ হয়ে আসছিল, বোধহয় ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতাও। ওরা শেষ দিনের প্রিপারেশন শুরু করে। তারপর…।
থানা অবশ্য কথা রেখেছে। ওদের মৃত্যু নিয়ে আর কাটাছেঁড়া হয়নি। পোস্টমর্টেম হয়ে আসার পর শেষবারের মতো মুখগুলো দেখিয়ে মৃতদেহ দুটোকে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো দাহক্ষেত্রে চুল্লিতে। পুলিশ চলে গেল, ওদের দায়িত্ব শেষ, আবার অন্য কোনো কোথাও অন্য কোনখানে ওদের দায়িত্ব। কিন্তু আমার দায়িত্ব যে শেষ হয়নি। আমি দাহক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে, আমি সন্তানের পিতা, আমার হাতে আমার সন্তানের মুখাগ্নির দণ্ড….। শ্মশান ভৈরবের মত এগিয়ে আসে দাহক্ষেত্রের ডোম, তার কৃষ্ণবর্ণ মুখে হলদে পাটির দাঁতগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে, গম্ভীর গলায় বলে – “নিন এবার আগুন দেন দন্ডে।”
আগুন জ্বলে ওঠে…., আমার হাতে দাউদাউ লাল আগুন… ছিটকে ছিটকে পড়ছে শব্দ কথা থুড়ি আগুনের ফুলকি….” ইস্যু আসলে খালাস করে দেবেন, সবই তো হরমোনের খেলা, ফষ্টিনষ্টি করে ফিরে আসবে, নিউ অন ওল্ড গন… মনটা বুঝবে…। খালাস করে দেবেন, নিউ অন ওল্ড গন…সবই তো হরমোনের…”
লাল দগদগে জ্বলন্ত শিখার শেষপ্রান্ত কালো কুণ্ডলী ধোঁয়া হয়ে উপরে উঠছে। গুলিয়ে গুলিয়ে পাক খেয়ে খেয়ে। তায় স্পষ্ট হচ্ছে ছায়াটা চন্ডাল হরিশচন্দ্রের মতো।
চমকে উঠি – এ ছায়া…, কার?
অবিকল সঞ্জয় মহাপাত্রের মত।
সঞ্জয় মহাপাত্র কে?
কেন আমি?
আমি কে?
কেন মৃতদের পিতা। এই মুহূর্তে এটাই তো সত্যি জানো।
হা হা হাসির মতো আগুনটা ছড়িয়ে পড়ে। দাহক্ষেত্র কেবল মৃতদের।
দাহক্ষেত্র কেবল পোড়ার জায়গা। এখানে সব পুড়ে ছাই হয়। সবকিছু পোড়ে, সবাই পোড়ে। মৃত জীবিত সবাই।
এতক্ষণে পোড়ার গন্ধ পাচ্ছি। চামড়া পোড়ার উৎকট কটু গন্ধ চারদিক ছেয়ে। নাক মুখ জ্বলে যাচ্ছে। শুধু কি নাক মুখ! আর কোথায় হাতড়াতে থাকি। কিছুক্ষণ আগে কারাও পুড়ে গেছে। তাদের নাকি কলিজাটাও পুড়েছে। আমার কলিজাটা! হাত রাখলাম বুকে। পাওয়া গেল না। উপড়ে গেছে নাকি! কেমন বমি বমি লাগছে। মুখ দিয়ে কিছু তুলে ফেলার চেষ্টা করি।
পোড়ার শেষে অবশ্য উঠে আসবে অমৃত। এটাই সত্য। অমৃত পান করে ফিরে যাবে অমৃতের সন্তানরা যে যার জায়গায়। ধরে রাখা যাবে না। যায় না।
আমরা সবাই অমৃতের সন্তান। পৃথিবী কেবল তার লীলাভূমি।
আমিও মেনে নিলাম। আমি যন্ত্রচালিতের মতো আগুনের দন্ডটা নিয়ে আগাতে থাকি, দুটি চির ঘুমন্ত মুখের দিকে। দুটি অমৃতের সন্তানের দিকে, আমি যে তার লীলার অংশ।
ডোম তার চিরাচরিত কর্তব্যের গলায় বলে – “এবার তিন পাক ঘোরেন।”
আমি গুণতে থাকি – এক, দুই…এক, দুই…।
পাক খেতে খেতে গভীররাতে আমি ঘরে ফিরি। দেখি – আমার স্ত্রী বিছানা নিয়েছে একটা অর্ধমৃত কীটের মতো, আর সেই বিছানার চারপাশে পাক খেয়ে খেয়ে ঘুরছে, আর মুখে বিড়বিড় করছে মনোরমাদি – “খায় দায় পাখিটি/ বনের দিকে আঁখিটি।”
আমি একগ্লাস দুধ গরম করে আমার স্ত্রীর মুখে তুলে ধরি, চেতনা ফেরাতে। আর মনোরমাদির চোখমুখে জলের ঝাপটা দিই। ওদের নিজস্ব পরিসরে একটু ঘুমের ঝিমুনি মত আসে, আমার আসে না। আমাকে ঘুম ছোঁয় না, কোনো কিছুই ছোঁয় না। তবু চোখ জ্বালা করে, আমি শক্ত হয়ে উঠছি ঘুমের মুখোমুখি – আমি পুনমের বাবা।




এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান