এই পরবাস – পর্ব ৫

অনিন্দিতা মণ্ডল 

(৫)

বীতশোক এখনও সকালে উঠে মাটির উঠোনের ধারে তুলসী গাছে জল দেন। মন্ত্র পড়েন – হে কৃষ্ণ করুণাসিন্ধু দীনবন্ধু জগতপতে।  

কর্মসূত্রে নিজে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ালে কী হবে, ওপার থেকে এসে বাবা যে এই ছোট্ট জমিটুকু পেয়েছিলেন সেই জমিই তাঁর মনে এক বিশাল পিতৃভূমির স্মৃতি জাগিয়ে রাখে। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দে তাঁর দেশের বাড়ি মনে পড়ে। তিনি তাই সামর্থ্য সত্ত্বেও বড় বাড়ি তুললেন না। কাঁচা উঠোন রেখে দিলেন। বাবার হাতে তৈরি ঘর। 

মা শেষদিকে বিরক্ত হতেন। বৃষ্টিতে পেছল উঠোন পেরিয়ে রান্নাঘর স্নানঘরে যাওয়া কষ্ট হতো। কিন্তু বীতশোক চাননি। কেন? দেশের বাড়িতে কি বৃষ্টিতে পিছল হত না? তারপর মা চলে গেলেন। মাধবীও চলে গেছে প্রবাসেই। কী এক হাড়ের অসুখ ছিল! ছেলেরা বাইরেই থাকে। প্রবাসে বড় হয়েছে। কাজকর্ম সেখানেই। বীতশোক একাই থাকেন। ছেলেরা অনুযোগ করে। “বাবা একা কেন থাকবে? আমাদের কাছে এসে থাকো।” কিন্তু বীতশোক এই ভাল আছেন। অতীত ধরে থাকার তাগিদ অনুভব করেন। যেন মা আর বাবা এখনও গড়ে তুলছেন নতুন বসত। কাঁচা মাটির উঠোন সেই অতীতের কথা মনে পড়ায়। নিয়মিত কিছু কাজ করেন। ঘরদুয়ার নিজে পরিষ্কার রাখেন। রবির মা রেঁধে দিয়ে যায়। ওর ছেলের বউ বাসন মেজে দেয়। 

বীতশোক স্থানীয় লাইব্রেরিতে সময় কাটান। বেশ পুরনো লাইব্রেরি। বই পড়েন। লাইব্রেরির নতুন বইয়ের লিস্ট তৈরি করে দেন। এখানে অনেক সব কবি লেখক থাকেন। সকলের সঙ্গে আলাপ না থাকলেও বীতশোক ‘জাগরণ’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত থাকার ফলে অনেককে চেনেন। 

দেলপাড়ার রমেন্দ্রকুমারের সঙ্গে তাঁর কয়েকবার দেখা হয়েছে। ভারী শৌখিন মানুষ। একটু যেন অহংকারীও। অধ্যাপক আবার কবি। স্নেহময় যায় মাঝে মাঝে। ওর সঙ্গেই যাওয়া। তবে বীতশোক যেন জটিলতা অনুভব করেন। স্নেহময় জটিল নয়। রমেন্দ্র বড় গভীর ও জটিল। বীতশোককে তত আমল দিতে চান না যেন। কেন? বীতশোক কবি নন বলে? নাকি তাঁর বংশগৌরব বলে কিছু নেই তাই? 

আজ বিকেলে স্নেহময়ের কাছে যাবেন। সাইকেল চালানোর অভ্যেস এখনও জারি রেখেছেন। বিকেল হতেই বেরিয়ে পড়লেন। 

স্নেহময় একসময় গান্ধীর ভক্ত ছিলেন খুব। খদ্দরের ধুতি পাঞ্জাবি ছাড়া এখনও কিছু পড়েন না। রাজীব গান্ধী মারা যাওয়ার পর থেকে ভারতের রাজনীতি নিয়ে আর মাথা ঘামান না। বীতশোক মুখে কিছুতেই প্রকাশ করতে পারেন না, একদা সাম্যবাদে বিশ্বাসী তিনি মরিচঝাঁপির পর কিছু কিছু মানুষের মুখের দিকে তাকাতে ঘেন্না পান। 

অকাল বর্ষায় স্নেহময়দের রাস্তাটা পাকা হলেও ভিজে ঢোল। সাইকেল টাল সামলাতে সামলাতে সত্তর পেরোনো বীতশোক ব্যস্ত ঘোষপাড়া রোড পেরিয়ে যাচ্ছেন। হাতে একটা চিঠি। সিলেট থেকে জ্ঞাতি বোন চিঠি দিয়েছে। স্নেহময়কে দেখাবেন। কতদিন পর! এ জীবনে দেখা হবে না হয়ত তবু বুকের মধ্যে চিনচিন করে। পিতৃভূমি। 

স্নেহময়ের গিন্নি যে বীতশোককে তেমন পছন্দ করেন না সে তিনি জানেন। বাঙাল বলে একটা নাক সিঁটকোনো আছে। বিচার আচার নেই। মুসলমানদের সঙ্গে থেকে থেকে ম্লেচ্ছ হয়ে গেছে। আব্রুও কম। একটু এড়িয়ে চলেন। ভাগ্যিস মাধবীকে এখানে আনতে পারেননি! কিন্তু স্নেহময়ের প্রীতি এত গাঢ় যে তাকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। 

সদর পেরিয়ে ভেতরে ঢোকার মুখে দেবেনের সঙ্গে দেখা। বীতশোক সাইকেলটা ছেড়ে দিলেন। দেবেন তাঁর সাইকেলটা ব্যবহার করে। তিনি এলে সে তাই খুশি হয়। তাড়াতাড়ি কাজ সারতে সুবিধে হয়। বীতশোক ভেবেছেন একটা সেকেন্ড হ্যান্ড সাইকেল তিনি দেবেনকে উপহার দেবেন। এমন বিশ্বস্ত ভৃত্য পাওয়া ভাগ্যের কথা। তাঁদের তো ভৃত্যরাই দেশছাড়া করেছিল। দেবেন অল্প হেসে বলল, “ছোটবাবু ছাদে বসে আছেন।” 

সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছেন বীতশোক। এ সিঁড়ি সদরের গা দিয়ে সোজা উঠে গেছে। অন্দরে যাবার দরকার হয় না। এ বাড়িতে অন্দরে ঢোকা যায় না। অতিথি বন্ধু পুরুষেরা এ পথেই যাওয়া আসা করেন। ডাইনে স্নেহময়ের ঘর, বাঁদিক দিয়ে অন্য শরিকের দরজা। স্নেহময়ের ঘরের হলুদ আলো ছায়া ফেলছে সিঁড়িতে। বিকেল হতেই আলো জ্বেলে দিয়েছে কেউ। বীতশোক সোজা ছাদে গেলেন। স্নেহময় পিছন ফিরে বসেছিলেন। বীতশোক ছাদের কংক্রিট বেদির ওপরে বসছেন আর তখনই স্নেহময় বললেন, “খবর দেখেছ? অমরনাথ যাত্রায় একশ চুরানব্বই জন বরফে জমে মারা গিয়েছে। জানো?” 

 বীতশোক জানেন না। রেডিওর খবর শোনেননি। স্নেহময় নিশ্চয় টেলিভিশনে শুনেছেন। বরফে জমে মারা গেছে? তীর্থ করতে গিয়ে? বীতশোক চমকে উঠলেন। আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া তিনি দেখেছেন, কিন্তু বরফে জমে যাওয়াটা ঠিক ধারণা করতে পারছেন না। স্নেহময় ফিরে চাইলেন, “ঘরে চলো। আকাশ পরিষ্কার হলে দু’ একটা তারা দেখতে পাব, এই আশায় বসেছিলাম। ঘন মেঘ জমে আছে। শুনলাম অন্ধ্রর উপকূলে নিম্নচাপ। তারই জের হবে।” 

দুজনে ঘরে এসে বসেছেন। স্নেহময় একটা খাতা নিয়ে এলেন, “বোসো। রমেন্দ্র নতুন কবিতা লিখেছে, শোনো।” 

পাঁচশো বছর যদি বরফের নীচে শুয়ে থাকি/  

আলাস্কায়, কিংবা হিমদূর হিমালয়ে,/ 

তিরিশ হাজার ফুটে, তবে এই সুরক্ষিত দেহ/  

ঘুম ভেঙে যাকে খুঁজবেমৃদু রোদ, হেমঘ্ন ঝংকার,… 

স্নেহময় থেমে যান। বীতশোক ভাবেন, অমরনাথের ওই হিমমগ্ন শবের সঙ্গে কে একাত্মতা খোঁজে? রমেন্দ্র? নাকি স্নেহময়! এই একটি আত্মিক যোগেই স্নেহময় রমেন্দ্রের সঙ্গে জুড়ে আছেন। অথচ দুজনে কত প্রভেদ! স্নেহময় পড়তি বংশ। জমিদারি আর নেই কিন্তু বাহার আছে। বিদ্যার গরিমা নেই। কিন্তু প্রখর আভিজাত্য। সে বিবাহিত ও ঘোর সংসারী। অকৃতদার রমেন্দ্র সেখানে এখনও বিগত বংশগৌরব আর জমিদারি ভুলতে পারেন না। বিদ্বান মানুষ, কবিকে ছাপিয়ে যান কোথাও কোথাও। অন্তত তাঁর তো তেমনই মনে হয়। স্নেহময়ের মতন সহজ সুন্দর নন বলেই বীতশোকের মনে হয়েছে। 

জাগরণের জন্য তিনি স্নেহময়ের কাছ থেকে একটি কবিতা চেয়েছেন। 

স্নেহময় উঠে গিয়ে নিজের খাতাটা এনেছেন। “আছে কি তেমন কবিতা? দাঁড়াও দেখি।” 

পাতা উল্টোতে উল্টোতে চোখে পড়ল কতকাল আগের লেখা। আচ্ছা? এতদিন আগের লেখা কি এখনও প্রাসঙ্গিক? সকলেই কি কালাতীত হতে পারে? না হয়? তিনি মাথা নাড়লেন, “না বীতশোক, আমার কবিতা বড় অন্তঃসারশূন্য। পাতা ভরাবার জন্য এসব ছেপো না।” বীতশোক জানেন, স্নেহময় অকৃত্রিম। মনে পড়ল তাঁর। বললেন, “জানো, কলেজ স্ট্রিটে প্রেসে গেছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখি সুনীল গাঙ্গুলি বসে। বললাম, ‘একটা কবিতা দিন না। আমরা মফস্বলের পত্রিকা। তেমন বিখ্যাত তো নই। যদি একটা কবিতা দেন তাহলে কাগজের নাম হয়।’ বললেন, ‘আমার কবিতা তো দিতেই পারি। দিয়েও থাকি। কিন্তু আপনারা যে কাগজ করছেন তা নিজেদের উদ্যোগে তো?’ সায় দিলাম, ‘হ্যাঁ, নিজেদের গাঁটের কড়ি ফেলেই কাগজ। বিক্কিরি তো হয় না, বিলিয়েই দিই বেশি।’ উনি শুনে হাসলেন, ‘বেশ করেন। নিজেদের কথাটা বলে যেতেই হবে। নিয়ম। আমার কবিতা একবার ছাপতেই পারেন। কিন্তু আমি বলি কী, যখন কাগজ করছেন নিজেরা তখন নিজেদের লেখা ছাপুন না কেন? দুটো লোকে কিনবে বলে আমার লেখা ছেপে কী হবে? আপনাদের বলবার কথাটা তো বলা হবে না! আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা রইল আপনাদের প্রতি।’ বলে আমার থেকে সেবারের জাগরণ এক কপি কিনে নিলেন। কী বলব স্নেহময়, এত আনন্দ কখনও পাইনি। অনুরোধ করেছিলাম, যেন একটি চিঠি অন্তত লেখেন। পত্রিকা সম্পর্কে তাঁর মতামত গুরুত্বপূর্ণ।” 

স্নেহময় হাসলেন, “কবিতা পেলে না বলে চিঠি ছাপবে, এই তো?” বীতশোক উত্তর দিলেন না। মনের মধ্যে ভাললাগাটুকু ধরে রেখেছেন। 

একসময় নিস্তব্ধতা ভেঙে স্নেহময় বললেন, “বীতশোক, গলির বস্তি থেকে একটি ছোট্ট মেয়ে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়েছে, শুনেছ?” বীতশোক তাকিয়ে রইলেন, কথা এখনও শেষ করেননি স্নেহময়।  

“মেয়েটা দেহাত থেকে বিয়ে হয়ে কয়েক মাস হল এখানে এসেছে। ওখানে গাঁয়ে ওর হয়ত ফাঁকা মাঠে খেতে আগাছার ঝোপে নিঃসংকোচ চলাফেরা ছিল। এখানে ঝুপড়ির মধ্যে গায়ে গায়ে জীবন। নিত্যদিন ঝগড়া। জলের লাইন কেরোসিনের লাইন রেশনের লাইন, তার ওপরে মিল বন্ধ। পুরুষগুলো রাজমিস্ত্রির কাজে যায়। ওপারে কটা কারখানা চালু আছে, যায়। তবে বেশির ভাগেরই জুয়ার নেশা। দিশি মদের নেশা। অকর্মণ্য অলস। মেয়েরাই বরং এই মফস্বলের অধিকাংশ গেরস্তের কাজের জোগান দেয়। তাদের ওপরেই মুলত সংসার দাঁড়িয়ে। মেয়েটা হয়ত এমন পরিবেশ দেখেনি। হাঁপিয়ে গিয়েছিল। তার ওপরে ওর বিয়ে হয়েছিল বুধুয়ার সঙ্গে। তুমি জানো না, ও ছেলেটা অল্পবুদ্ধি। জড়বুদ্ধিও বলতে পারো। সে বিয়ের বোঝে কি? মেয়েটাও পুরোপুরি বুঝত বলে মনে হয় না। তুমি জাগরণে এদের নিয়ে লিখতে পারো! এদের কথা কে লিখবে বলো? এদের কথা তো কেউ লেখে না? তুমি লেখো বীতশোক।” 

বীতশোকের কুণ্ঠা হয়, “আমি কি লিখতে পারব? আমার গদ্য তেমন ভালো কি?” স্নেহময় বিরক্ত হন, “কেন? লিখলেই পারবে! তুমি তো মানুষের বঞ্চনার ইতিহাস জানো। উদ্বাস্তুর যন্ত্রণা জানো, হঠাৎ সব হারানোর ভয় যন্ত্রণা জানো, তাহলে এদের কথাই বা লিখতে পারবে না কেন? এইসব মানুষও তো ছিন্নমূল! কোথায় দেশ গাঁ দেহাত আর কোথায় এদের থাকতে হয় জীবিকার তাগিদে! ভেবে দেখো তো মিল পাও কিনা? নাকি অন্য ভাষা অন্য রকম মানুষ বলে একাত্ম বোধ করো না?” 

বীতশোক জানেন। বাঙালির একরকমের আত্মম্ভরিতা আছে। তিনিও তা থেকে মুক্ত নন। তবে এদের নিয়ে লেখার কথা তাঁর সত্যিই মনে হয়নি। পারবেন কি? স্নেহময়ের দিকে তাকালেন। স্নেহময়ই বা লেখে না কেন? তার তো লিখতে পারা উচিত ছিল। বীতশোক ধীরে ধীরে মাথা নাড়েন, “আমি চেষ্টা করব। পড়ে দেখো লিখতে পারছি কিনা।” 

স্নেহময় হাসলেন, “পারবে। তবে আগে তোমাকে এদের কথা জানতে হবে। এদের মনের মধ্যে ঢুকতে হবে। তোমাকে আমি একটা সূত্র দিতে পারি। তুমি দেবেনকে বলো অজয়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবে। অজয় আমাদের পুরনো গোয়ালা রামশরণের ছেলে। দেবেনের বন্ধু লোক। ওদের সঙ্গে আলাপ করে কথা বলো। জানতে পারবে। ভালও বেসে ফেলতে পারো। একবার ভালবাসতে পারলে তোমার পক্ষে লেখাটা সহজ হবে।” 

বীতশোক বলে ফেলেন, “তুমি এদের নিয়ে একটা কবিতাও লেখোনি? আমাকে দেখাও।” 

স্নেহময় খাতা খোলেন। 

জল তোমাদের ঘর গিলেছিল কি? 

নাকি খরার দেশে জন্ম তোমার? 

কত পথ হেঁটেছিলে স্বর্গের আশায়? 

এত এত প্রশ্ন তোমার ভালো লাগছে না, জানি। 

তুমি দুটো খেতে চাইছ। মাথার ওপরে ছাওয়া চাইছ। 

কিন্তু ইতিহাস ভূগোল না জেনে তোমাকে আশ্রয় দিই কি করে! 

মাটিতে শুয়ে পড়ার সময় ক্ষমা কোরো আমাকে। 

স্বর্গে পৌঁছলে সবাই দেবতা হয়। তুমিও। 

বললেন, “কবিতা আমি লিখতে পারি না, তুমি জানো। এ শুধু আবেগ।” বীতশোক হাসলেন, “আবেগই বা কজন অনুভব করে? কবিতা হল কিনা সে পরের কথা। কবিতাটা দিও। জাগরণে ছাপাব।” 

সেদিন ফিরতে ফিরতে বীতশোক ভাবলেন, সত্যিই স্বার্থপরতা। নিজেদের দুর্ভাগ্যের কথা ভাবতে গিয়ে আর কারোর দিকে তাকানো হয়নি। এই যে স্নেহময় কলেজে একসঙ্গে পড়েছেন, যার কাছে নিজের যত দুঃখ হতাশা মেলে দিয়েছেন, অকালে মাধবী চলে গেলে স্নেহময় তাঁর শোকে পাশে থেকেছেন। কিন্তু স্নেহময়ের কোনো নিরাশা বা স্বপ্নভঙ্গের কথা জানা হয়নি। এরকম তো হতে পারে না যে স্নেহময়ের কোনো অপ্রাপ্তি নেই জীবনে। কিন্তু জিজ্ঞেস করা হয়নি। সবসময় গ্রহীতা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। দাতা স্নেহময়। আজ যে লেখার কথাটি হল তাতেও স্নেহময় অন্য এক যাপনচিত্র লিখতে বলছেন। তিনি সেই রচনার কোথাও নেই। রেলগেট বন্ধ। দুটো ট্রেন পাস করলে তবে খুলবে। সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন বীতশোক। এপাশের বাজারটা বড়লোকেদের। অকালের দামি সবজি বসে। কেনা হয়নি। আজ কী মনে হতে অকালের একটা ফুলকপি কিনলেন। রবির মা বকুনি দেবে। তা দিক। কিন্তু দুজনে ভালই খাবেন, বীতশোক জানেন। 

দেবেন অজয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে। তার আগে নিজেই অনেক গল্প করেছে। বীতশোক শুনেছেন। লেখার প্রথম পর্ব মনের মধ্যে ঘনিয়ে এসেছে। 

অনেক রাতে, স্তিমিত হলুদ আলোয় লিখতে বসলেন। এখানে ভোল্টেজ খুব কম থাকে। রাত বাড়লে আলো একটু উজ্জ্বল হয়। হলুদ দিস্তা কাগজে পেন্সিল দিয়ে লিখতে বসেন বীতশোক। সত্যি বলতে এতটা কৃচ্ছসাধন না করলেও চলে তাঁর। ছেলেরা বিরক্ত হয়। কিন্তু বীতশোক অতীত ভুলতে পারেন না। উদ্বৃত্ত টাকা তিনি কমিটিতে দেন। এই হলুদ কাগজগুলো স্থানীয় এক কেটারারের কাছ থেকে কেনেন। ওরা কাজের বাড়ির খাবার টেবিলে পাতে। কম দামি ব্লটিং কাগজের মতো কাগজ বৈঠকখানা বাজার থেকে আনায়। বীতশোককে আনিয়ে দেয়। বীতশোক লিখতে শুরু করলেন — 

“নদীর ধারে বাস, ভাবনা বারো মাস। কখন ভালো কখন মন্দ কখন সর্বনাশ। 

এমন একটি প্রবাদ শোনা আছে অনেকেরই। কিন্তু নদীর সর্বনাশা রূপ চোখের সামনে কম মানুষ দেখেছে। পাহাড়ি নদী যখন গতিপথ পাল্টায় বা সমতলে বন্যায় যখন নদী দুকুল ভাসায় তেমন বিপর্যয় ছাড়াও বিপদ থাকে। যেমন বুধিয়ার কিশোরী বউটি। সামনে অমন বিস্তীর্ণ নদী তাকে মরণ ডাক দিল। বুধিয়া জড়বুদ্ধি। তার মা মনে করেছিল বিয়ে দিলে ছেলের বুদ্ধি খুলে যাবে। নারীর শরীর যে চিনতে পেরেছে সে তো পৃথিবীর সব রহস্য জানতে পেরেছে! ছেলে তার মানুষ হয়ে যাবে। কিন্তু বুধিয়া যেমন তেমনই রয়ে গেল। মাঝখান থেকে বুধিয়ার গেঁয়ো কিশোরী বউটি অত্যাচারে জেরবার হয়ে গেল। 

​গোয়ালা বাড়ির পেছনে রায়চৌধুরীদের মালির ঘর। সে এখন নামেই মালি। মাইনেকড়ি দেওয়ার কেউ নেই। ওদের সেই নামেই তালপুকুর, ঘটি ডোবে না। মালি এখনও বাগানের আনাচে কানাচে এটা ওটা করে। গলির লোকজনকে জড়িবুটি দেয়, শেকড়বাকড় দিয়ে দু পয়সা রোজগার করে। মালি-বউ উমা রায়চৌধুরী বাড়ির শরিকদের ঘরে কাজ করে। সেই উমার মুখ থেকে শোনা গেল, শেকড় খেয়ে বউটা নাকি কেমন হয়ে গেছিল। এই নিয়ে তার স্বামীর সঙ্গে উমা বিস্তর ঝগড়া করেছে। মালি বলেছে, শেকড়ের গুণ আছে। কিন্তু পুরুষমানুষ যদি বেগুণ হয় তো শেকড়ের দোষ কী? উমা বলেছে – ‘ঢ্যামনাবুড়ো! তু ওকে কী দিইচু বল? শয়তান! ডুব্বে মর মর!’ উমা মাথায় হাত দিয়ে বসেছিল। হাহুতাশ করে বলছিল, ‘কাউরে বলবেন না গো। পুলিশে নিবে। বুড়ো মার খাবে।’ 

​আসলে তো মালির জীবন মরণ। ও ওই করেই আয় করে। কিন্তু বুধিয়ার মা সব নষ্টের গোড়া। সে কেন মালির কাছে ওষুধ চেয়েছিল? বউ নাকি ছেলেকে বাঁধবে! শরীর দিয়ে! ছেলে শরীর কী জানে না। কেমন করে তা জাগে তাও জানে না। মাঝখান থেকে বুধিয়ার কাকা ঠিক নজর করেছিল। এমন সুযোগ হাতছাড়া করে কেউ? ওই এক চিলতে ঘরদোরে কিছুই গোপন থাকে না। বুধিয়ার বউয়ের এই কীর্তিও গোপন থাকেনি। উমা কাঁদছিল। কেউ জানে না কেন মেয়েটা ঝাঁপ দিল? সবাই জানে। পুলিশ জানে না। 

​উমা এদেশে বহুকাল। ওর সঙ্গে কথা বলতে বলতে জানা গেল ওদের ঘর ছিল মেদিনীপুরের পূর্বদিকে। হেরিয়া থানার লাখি গাঁ। বড় দরিদ্র ছিল ওরা। ওর স্বামী প্রথম হাওড়া আমতলায় এক বাবুর বাগান দেখাশুনো করতে আসে। নামমাত্র মাইনে। খেতে আর থাকতে দেবে। উমা দেশে থাকত। মুড়ি ভাজা ধান ভানা এইসব কাজ করত। দুটো মেয়ে নিয়ে দিন কাটাত। ওদের দেশে ক্যানালের গায়ে সরু বিট কাটা থাকত। ওরা ঝোড়া করে মাটি তুলে আনত। উঠোনের কোণে গর্তে সেই মাটি জড় করে চেপে দুরমুশ করত। তারপর খড় চাপা দিয়ে ওপরে জল ঢেলে দিত। পরে স্বচ্ছ সেই জল তুলে আগুনে জাল দিত। দেখতে দেখতে জল নেড়ে শুকিয়ে তুলত। পড়ে থাকত নুন। কত নুন তারা তৈরি করত! বাবুদের ঘরে, হাটে বেচে পয়সা হতো। তারপর মালি দেশে গেল। পরিষ্কার সাদা কাপড় পরনে, হাতে পুরনো ট্রাঙ্ক। উমাকে বলল, ‘নতুন কাজ হয়েছে, সঙ্গে চল।’ মেয়েরা? ‘নিয়ে চল। ওখান থেকে বিয়ে দেব। দেশে ঘরে দেব না।’ 

​উমার দুই মেয়ের একজনের বিয়ে হয়েছে লাটে। সুন্দরবনের ছোট ছোট দ্বীপকে ওরা বলে লাট। আর একজনের বিয়ে হয়েছে বাঁকুড়া। সে বড় ভাল আছে। উমা গিয়েছে তার কাছে। কিন্তু যে লাটে আছে তার সঙ্গে বিয়ে হয়ে এস্তক আর দেখা হয়নি। 

​কথার সুতো এইভাবে এগিয়ে যায়। একদেশ থেকে আর একদেশের মানুষের দুঃখ দুর্দশার কথা উঠে আসে। একথা লিখে রাখা কেন? কখনও যদি কেউ পুরনো হলুদ হয়ে যাওয়া কোনো এক অখ্যাত পত্রিকার পাতা উল্টোয় তাহলে জানতে পারবে কত মানুষ এক নদী ছেড়ে ক্যানাল ছেড়ে আরও বড় এক নদীর ধারে এসেছিল। ভাল থাকবে বলে।” 

বীতশোক দেখেন ভোরের নরম নীল আলো ফুটেছে। উঠোনের কোণে আতা গাছটায় দুটো বসন্ত বউরি লুকিয়ে যাচ্ছে পাতার আড়ালে। ওরাও কি অন্য দেশ থেকে এসেছে? ভাগ্যিস ওরা মানুষ নয়। 

(চলবে)… 

(স্নেহময়ের নিজের লেখা কবিতা ছাড়া বাকি কবিতা কবি রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরীর কিছু কবিতা থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে।) 

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

Blog at WordPress.com.

Up ↑