অনিন্দিতা মণ্ডল
(৬)
ঊর্মিলা গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে মরার পর থেকেই মুন্নির মা দেওরের সঙ্গে আর মেলামেশা করে না। বস্তির সকলেই জানে দেওরের সঙ্গে মুন্নির মায়ের ওঠাবসা ছিল। পীরিতের কথা জেনে লোকে তামাশা করত। কিন্তু হঠাৎ থুম মেরে গেছে। মুন্নি বুধিয়ার কাকা রাজু ইলেকট্রিকের কাজ শিখে কনট্রাক্টরের কাছে কাজ করে। ভাল আয় আছে। ওর দেশে জমিজমা আছে। ছেলেপিলে নিয়ে বউ সেখানে থাকে। মাঝে মাঝে দেশে যায় রাজু। এখানে এই নোংরা জায়গায় তার বউ থাকতে পারবে না, এরকমই সে বলে। মুন্নি বুধিয়ার বাপ কোন কালে অন্য মেয়েছেলে নিয়ে ভেগেছে। সেই থেকে সকলে আড়ালে বলে, মুন্নির চাচার দুসরা জরু দেশে থাকে। এখানেই ওর পহেলা বউ। সেই রাজু এমন কাজ করল? মুন্নির মা ঊর্মিলাকে বকেছে মেরেছে সুলঝিয়েছে, সবই তার ভালর জন্য। আরে বাবা তোর আপনার লোক কে? বুধিয়া ছাড়া আর কে আছে তোর? না যদি বাঁধতে পারিস, মানাতে পারিস তবে কী নিয়ে বাঁচবি? তা ভালো করতে নেই কি?
সেদিন মুন্নির মা গঙ্গার ধারে চুপ করে বসে ছিল। মন ভাল নেই। এদিকটা ফাঁকা একদম। বড় বাড়ির পুরনো নোনাধরা পাঁচিলের গায়ে আগাছা ভরা একটু জমি। সোজা গঙ্গায় নেমে গেছে। পাড় ভাঙছে নিশ্চয়। এখানে বসে বসে মুন্নির মা ওর বউটার কথা ভাবছিল। এখান থেকেই ঝাঁপ দিয়েছিল কি? ছি ছি! কী লজ্জার কথা! মুন্নির চাচার দোষ সবাই জানে। বুধিয়ার বউকেও ছাড়লি না? বউটা মরার কদিন যেতে না যেতেই রাতে মশারির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে মুন্নির মায়ের গায়ে হাত রেখেছিল ওর চাচা। ফিসফিস করেছিল, “আয় আয়।” মুন্নির মা এক ঝটকা দিয়ে ঠেলে দিয়েছিল। “বের হয়ে যাবি। খবরদার আমার ঘরে ঢুকেছিস তো। বেরো শালা। বহেনচোত শালা ছেলের বউকে ছাড়িস না! বেরো বলছি।”
রাজু চলে গিয়েছে। বস্তির লোকজন মুন্নির মায়ের সরাসরি আঙুল তোলায় সকলে একজোট হয়েছিল। রাজুকে বেরিয়ে যেতে হয়েছে। শুধু বুধিয়া, বোকার হদ্দ, বলছিল, “এ মা চাচা কিধর গিয়া রে? এ মা। বোল না।” মুন্নির মা ছেলের পিঠে এক কিল বসিয়েছিল বেমক্কা, “বুদ্ধু কাহাঁ কা! বহু ভেগে ভাল হয়েছে। রাখতে পারিস না, শাদি করে বহু এনেছিস!”
কয়েকদিন যেতে সকলেই ভুলে গেল এসব কেচ্ছা। কোথায় নতুন কী শুরু হল তাই নিয়ে সকলে উৎসুক। শুধু মুন্নির মা ভুলল না। মরদ ভেগে গেল। দেবর বদ। ছেলে বোকা। এক মেয়েকে নিয়ে সে ভুলতে চাইল। কিন্তু কী আছে কপালে কে জানে?
আজ এখানে বসে বসে সে ভাবছিল, গঙ্গামায়ি এত বড় আছে। সকলের এত এত পাপ ধুয়ে নেয়। তার পাপ কি সে জানে না। মরদ না হলে বাঁচবে কী করে এই ভয় থেকে দেওরের কাছে গিয়েছে। ঝামেলা ছিল না। দেওরের দেশোয়ালি বউ তো দেহাতে। আসে না। সেও কখনও দেশে যায় না। দেওর বলে, “ভাইয়া জমি বেচে চলে গেছে। ওখানে তোদের কিছু নেই। বুধিয়ার তাহলে কী হবে? কে দেখবে ওকে?”
সেই ভয় থেকেই বিয়ে দিল। রাজু নিজের চাচা। মুন্নির মা কী দেয়নি রাজুকে? তাই ভেবেছিল রাজু ভাতিজাকে দেখবে। ছেলের মতন দেখবে। শালা হারামখোর! ভাতিজার বউটাকে পর্যন্ত ছাড়লি না? মুন্নির মা শুনেছে, রেললাইনের ওপারে একটা ছেলের সঙ্গে ভাব হয়েছে মুন্নির। গতর খাটিয়ে তো খায় মুন্নি। ওদিকে ছেলের পাকা ঘর আছে। মাথার ওপরে ছাদ আছে। গঙ্গার ধারের এই ময়লা থেকে সে দূরে থাকবে সেই ভালো। ছেলেটা বাঙালি। বাঙালিরা সভ্য হয় মুন্নির মা জানে। মেয়েটা ভাল থাকবে। এক এক সময় তার মনে হয় গঙ্গার জল ঠাণ্ডা। জ্বালা জুড়োতে সেও ঊর্মিলার মত ডুবতে পারে। কিন্তু বুধিয়া?
তবু মুন্নির মা জলে ঝাঁপায়। সারা শরীরে জল মাখতে মাখতে ডুব সাঁতার দেয়। আবার ভেসে ওঠে। মনে মনে প্রার্থনা করে, মা, দোষ নিস না, মা। ছেলেপিলেকে বাঁচাতে খারাপ হয়েছি মা। তুই মা। তুই তো বুঝিস।
পাঁচিলের ওপাশে তখন বিকেলের পুকুরে ডুব সাঁতার দিচ্ছে শুভা। এই সন্ধ্যের ঝোঁকে পুকুরে নামতে তার খুব ভালো লাগে। সব ক্লান্তি সব গ্লানি কেটে যায়। ধারে ধারে কলমির ঝাড় বেঁধে আছে। সেসব দুহাতে সরিয়ে মাঝপুকুরে চলে যায় শুভা। পাঁচিলের ওপাশেই গঙ্গা। কিন্তু গঙ্গায় যেতে তার মন চায় না। গেলেই সে ছোটমা’র মতো ছুঁচিবাইয়ে ভুগবে। নিত্যদিন যা করে ছোটমা! কী পাপবোধ ছোটমা’র? কে জানে! আজ সাঁতার দিতে দিতে সে যেন কার গলা পাচ্ছিল। পাঁচিলের ওধারে জঙ্গলে কে? মেয়ের গলা তো। শুভা ভুস করে ভেসে উঠল। নোনা পাঁচিলের গায়ে দুটো ইট সরেছে। সেখান দিয়ে দেখল, মুন্নির মা এক লাফে গঙ্গায় পড়ল। তারপর সাঁতার দিতে থাকল। বাঃ! আপনমনেই হেসে উঠল শুভা। আজ ভারি আনন্দের দিন। ভারি আনন্দের দিন। বেশি আনন্দ হলেই তার পা দুটো হালকা হয়ে যায়। নির্ভার। যেন কোনো রূপোলী মাছের শরীর। সে পা দুটো ঝাপটায়। জলে ঢেউ ওঠে। মাছের লেজের মত পা দুটো সেই বৃত্তে তরঙ্গ তোলে।
সন্ধ্যেয় ঠাকুরঘরে বাতি দিতে দিতে সেজগিন্নি দেখতে পায় পুকুর তোলপাড়। বাবা! কোথাকার ডাইনি এসে জন্মেছে! মেজদির কোল ভাল না, ছি!
আজ সকালে পল্টু এক ভ্যান ইঁট এনে হাজির হয়েছিল। সদরে মালি আর দেবেন ছিল। ছোটমা যে কালো গরুটা নিতে দিল না সেই নিয়ে দুজনে দুঃখের কথা বলছিল। আহা নিলে কত ভাল হত! ঘরের ঘাস খেয়ে দুধ দিত। মালির দুর্বল শরীরে বল আসত। সে বলেছিল দেবেনকে, “কতগুলো শেকড় আছে যাদিগে রাতে দুধ খাবাতে লাগগে রে। শেকড়ের গুণ বাড়ে।” কেউ না বিশ্বাস করুক দেবেন জানে গুণ আছে মালির। নাহলে বুধিয়ার বউয়ের এমন হল কেন? সে তাই তক্কে তক্কে থাকে। কিন্তু উমা তাকে দেখলেই বলে, “যা এখান থেকে! তুই বেটাছেলে? নাহ। তুই বেটাছেলে নয়। শেকড়ে তোর কী করবে? আর ওই বদ মিনসে! কিচ্ছু জানেনি, কিচ্ছু পারেনি, খালি মিথ্যে। যা পালা। নয়ত বলে দুব আমি। ছোটবাবুকেই বলে দুব।”
আজও সেই কথাই হচ্ছিল। এমন সময় পল্টু এল।
পল্টু ওদের দেখে একমুখ হাসল, “সর গো। ভেতর বাড়িতে ইঁট ফেলার হুকুম আছে।” মালি এগিয়ে এল, “তা হুকুম দিল কে?”
– “সে তোমাকে বলব কেন? বাবুদের ব্যাপার? এক ভ্যান কী দেখছ? অনেক ভ্যান আসবে। ইঁট আসবে। সিমিন্ট আসবে। অন্নেক ব্যাপার। সরো সরো।”
সদর পেরিয়ে সত্যিই পল্টু ইঁট নিয়ে হাজির হয় বড়দের দালানের পাশে। উঠোন ভেঙে চৌচির। সেখানেই জড়ো করে ইঁট। তারপর গান গাইতে গাইতে বেরিয়ে যায়। কে এক নতুন নায়ক এসেছে, শারুক খান। একদম ঝাকাস। সিনেমার গানটা পল্টুর খুব ভাল লেগেছে।
‘তুম পাস আয়ে অউর মুস্কুরায়ে…’
ইঁট পড়েছে কেন কে জানে? শুভার ঘরের গা ঘেঁষে ইঁটের পাহাড় হয়েছে। এখন চারিদিক বন্ধ। এই আঁধারপুরীতে কেউ আসে না। তবু শুভা জানলা দরজা বন্ধ করল। হলুদ কম পাওয়ারের বাল্ব জ্বালিয়ে আলমারির সামনে এসে দাঁড়ালো। নিরাবরণ শরীর তার। কত বয়স হল শুভার? সেজকাকাবাবুর অনেক বয়সে ছেলে হয়েছে। তার বাবারও তো বয়সে সন্তান! কিন্তু তার এই শরীরে কত কত সুর আছে! কত রাগ রাগিণী বাজে, কেউ জানে? শুভা ধীরে ধীরে নিজেকে ছোঁয়। কপাল থেকে ভেজা আঙুল নামিয়ে আনতে থাকে। সিক্ত ভুরু, গালের পাশ দিয়ে ঠোঁটে নেমে আসে আঙুল। তারপর কণ্ঠার হাড় বেয়ে বুকে। শিরশির করে শরীর। নিজেকে ছুঁয়ে দেখতে বড় ভাল লাগে। জল ছুঁলেও এমন শিরশির করে শরীর। নাভিতে জলের ফোঁটা বসে আছে। আঙুল পৌছতেই টপ করে জলের ফোঁটা আঙুলে উঠে আসে। শুভার ঠোঁট শুকিয়ে আসে। চোখ বন্ধ হয়ে আসে। ঠিক এই মুহূর্তে সে সব ভুলে যায়। দৌড়ে দরজা খুলে ছুটে গিয়ে লাফিয়ে পড়ে পুকুরে। সে জলে দুরন্ত সাঁতার দেয়। থামে না। শরীরের শিরশির যতক্ষণ না রিনরিন বেজে ওঠে সে সাঁতার দিতেই থাকে।
রান্নাঘর থেকে পুকুরের দিকে চেয়ে ছিল শ্রী। চাঁদের আলো এসে পড়েছে পুকুরে। সন্ধ্যে কখন পেরিয়ে গেছে! শুভাদিদি এখনও পুকুরে? কী করছে? জ্বর সর্দিও তো হতে পারে! শ্রী রান্নাঘরের ছোট দরজা দিয়ে পায়ে পায়ে বেরিয়ে আসে। সেই ঘন অন্ধকারে ভরা পথ। শুভার ঘরের দিকে যাওয়ার পথ। এর ডান দিকে গাছের আড়ালে দেখতে পাওয়া যায় পুকুরের জল। শুভা তোলপাড় করছে পুকুর। যেন তিমি মাছ নেমেছে জলে। শ্রী চুপ করে দাঁড়ায়। তার ছায়া দেখে শুভা ধীরে ধীরে পারের কাছে আসে। আবছা এক অদ্ভুত খিলখিল হাসি হাসে সে। “কী হয়েছে শ্রী? কী হয়েছে তোমার? আমাকে খুঁজতে এসেছ? হাত ধরো তবে।” শ্রী হাত বাড়িয়ে দেয়। মনে ভাবে শুভা উঠে আসবে। কিন্তু তাকে চমকে দিয়ে শুভা তাকে এক টানে জলে নামিয়ে আনে। ভয়ে গলা শুকিয়ে গিয়েছিল শ্রীর। কিন্তু শুভা ওকে ঠেলে পারে তুলে দিল। খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, “আমি থাকতে জলে তোমার ভয় কী? আমি চাইলে সারারাত জলে থাকতে পারি।”
শ্রী পায়ে পায়ে পিছিয়ে এল। আবছা অন্ধকারে সত্যিই শুভা যেন একটা বড় মাছের মতই জলে খেলছে। মাছের মতই নির্ভার তার শরীর। একটা ভয় বুকে নিয়ে ফিরে এল শ্রী। ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে গিয়েছিল। ভেজা ছপছপে শরীর নিয়ে রান্নাঘরের দোর দিয়ে ঢুকে গেল। কলঘরে গিয়ে গায়ে জল ঢালতে থাকল। পুকুরের জল ভারি যে! উঃ! শুভাদিদি তো ভারি অদ্ভুত? এমন করে কেউ জলে টেনে নামায়? সে সাঁতার জানেই না তো! পাগল একটা। ডুবে মরে গেলে কী হত? এ কথাটা যে কাউকে বলা যাবে না সেটা শ্রী বুঝেছে। এ কথাটা একটু অদ্ভুত।
রাতে চাঁদের আলো এসে পড়েছে বিছানায়। শ্রী সায়নের পাশে বসে আছে। সায়নের সঙ্গে কথা বলার সময় এই এখন। সারা বাড়ি নিস্তব্ধ হলে সায়ন আর একবার দেখে আসে বাবাকে। ঘুমের মধ্যে বাবা যেন ছোট হয়ে যায়। মুখে কতরকমের অনুভূতি ফুটে ওঠে। সায়ন দ্যাখে। ঘুমের মধ্যেই বাবা পাশ ফেরে। গায়ের চাদর সরে যায়। সায়ন সন্তর্পণে টেনে দেয়। বাবা যে তাকে বাইরে যেতে দিল না, কেন দিল না, এসব সে জানে। কিন্তু বাবার ওপরে অভিমান হয় না। শ্রীয়ের হয়ত হতে পারত। কিন্তু বাবা অপরিসীম স্নেহ দিয়ে তাকে ভরিয়ে দিয়েছেন। শ্রীয়ের অসমবয়সী বন্ধুও বটে আবার বাবাও বটে। শ্রী নিজেই কতবার বলেছে, “আমার নিজের বাবাও আমার সঙ্গে কখনও এত কথা বলেনি।”
বাবার ঘরের পরেই চাতালের একপাশে লম্বাটে একফালি ঘরে দেবেন শোয়। নীচে মায়ের ঘরে থাকে আরতিদি। রাতে এমনিতেই ওদের শোয়ার জায়গা বাড়ন্ত। এই ব্যবস্থা তাই আরতিদির জন্য সুবিধের। সায়ন খাটে কাত হতে হতে বাসি খবরের কাগজটা নাড়ে। টিভি দেখার অভ্যেস শুধু ছুটির দিনে। এখনই শ্রী এসে বসে। রোজ রোজ সায়নের তেমন কিছু বলার থাকে না। শ্রীই সারাদিনের কথা বলে।
–“জানো, আজ মোড়ের ঘনশ্যাম হার্ডওয়্যারের পল্টু এসে অনেক ইঁট ফেলেছে।”
–“কোথায়?”
–”শুভাদিদিদের দালানের লাগোয়া উঠোনটায়।”
–“কেন?”
–”আমি জানব কী করে? বাবা জানেন মনে হয়। বাবা পল্টুর সঙ্গে কথা বলছিলেন।”
সায়ন পাতা উল্টোয়। খেলার পাতায় তেমন খবর নেই। ক্রিকেটটা ক্রমশ বোরিং হয়ে উঠছে। হঠাৎ বলে উঠল, “কুছ কুছ হোতা হ্যায় দেখতে যাবে? শুনছি বেশ একটা ফিল গুড ব্যাপার আছে ছবিটায়।” শ্রীর মনে পড়ল, সায়নের সঙ্গে শেষ সিনেমা দেখেছিল দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে আর উনিশে এপ্রিল। বিয়ের আগে। আজ সায়নের কথায় খুব আনন্দ হল। আচ্ছা, শুভাদিদি কি সিনেমা দ্যাখে? দেখতে যায় কখনও? বাজারে যাওয়া ছাড়া কোথাও তো যেতে দেখেনি তাকে? কেউ আসেও না তার কাছে। শুভাদিদি এমন কেন? শ্রী বলে, “আমাদের সঙ্গে শুভাদিদি সিনেমায় যেতে পারে না?”
–”পারে বইকি। তবে যাবে না। কোথাও যায় না তো।”
শ্রীর মনে পড়ল। শুভাদিদিকে সকলে অপয়া বলে খারাপ বলে। কারণটা সে জানে না। এই কদিনে জানাও তো যায় না।
–“আচ্ছা একটা কথা বলবে?”
–”কী?”
—”শুভাদিদিকে সকলে খারাপ বলে কেন? সেজমা তো সারাক্ষণ গালমন্দ করে। কেন বলো তো? বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। বাবা বললেন, বাবুকে জিজ্ঞেস কোরো।”
সায়ন হেসে ফেলল, “বাবা একথা বললেন?”
–”হ্যাঁ গো বললেন।”
সায়ন বিব্রত হয় প্রথমে। তারপর বলে, “তুমি দাদাভাইকে দেখোনি তো। বাইরে থাকে। বিদেশে। এখন সম্ভবত ফ্রান্সে আছে।” শ্রী মাথা নাড়ে, “না দেখিনি, তবে শুনেছি। বাবা বলেছেন, মা-ও বলেছেন। তোমাদের বংশের মুখ উজ্জ্বল করা ছেলে।” সায়ন হাসে। মুখে লজ্জার হাসি।
–“হ্যাঁ। দাদাভাই আমাদের অতীত গৌরব ফিরিয়ে দিয়েছে। এ বাড়িতে যেমন গোপালের মত অপদার্থ আছে, শিশিরের মতন স্বার্থপর আছে, আমার মতন সাধারণ আছে, তেমন দাদাভাইয়ের মতন অসাধারণও আছে।”
শ্রী হেসে ফ্যালে, “তুমি সাধারণ? কই?” সায়ন জানলা দিয়ে বাইরে তাকায়, “নিজেকে, নিজের অসাধারণত্ব যাচাই করতে, দড়ি কেটে বেরোতে হয়। প্রতিভা আদৌ আছে কিনা জানতে ছোট পুকুর থেকে বড় খাল-বিল নদী-নালা পেরিয়ে সমুদ্রে পড়তে হয়। তবে জানা যায় নিজেকে। সে এক অনন্ত সাঁতার শ্রী। বাবা যেতে দেননি সে অন্য কারণ। নিজেকে যাচাই করতে আমারও কি ভয় ছিল না?”
–“তোমার দাদাভাইকে তার বাবা ছেড়ে ছিলেন?”
–“ছেড়ে ছিলেন।”
শ্রী আবার শুভার প্রসঙ্গে ফেরত গেল। সায়ন যে এ কথাটা বলতে চাইছে না এরকম একটা বোধ কাজ করছে। সায়ন চিত হয়ে শুয়ে পড়ল।
–“কথাটা শুনে ভুলে যেও শ্রী। দাদাভাই এখানে থাকলেও একই থাকত। ও অসাধারণ। কিন্তু ওকে যেতে হয়েছে শুভাদিদির কারণেই।”
–“কেন? শুভাদিদি এর মধ্যে কোথায়? বরং শুভাদিদির নিজের দাদা, ওই যে শিশির যার নাম, তাকেও অবিশ্যি আমি দেখিনি, সেই তো খুব স্বার্থপর শুনেছি! তোমার দাদাভাই তো নিজের মায়ের পেটের দাদা নন শুভাদিদির?”
–“শ্রী, শিশিরদা একটা স্বাভাবিক মানুষ। ও মেধাবী। আইআইটি থেকে বেরিয়ে সোজা স্টেটসে চলে গেছে। এখানে আসেনি। ওর স্বার্থপরতা বলতে ও এই পুরনো বাড়িটায় ফিরতে চায়নি। চায় না। অসম্ভব একটা স্বচ্ছল সুন্দর জীবনে অভ্যস্ত ও। ওর বিষয়ে কেউ আমরা তেমন জানিও না। ও জানাতে চায় না। এ বাড়ির সঙ্গে ও নাড়ির যোগ কেটে দিয়েছে। শুভাদিদির দায় ও নেয়নি। নেবেও না।”
–“কেন? নিজের বোনের দায়িত্ব নেবে না কেন?”
–“কারণ শিশিরদা এই দায় নামানোর একটা অজুহাত পেয়েছে।”
–“কী!”
–“দাদাভাই শুভাদিদির দায়িত্ব নিয়েছে।”
–“তোমার দাদাভাই তবে মনের দিক থেকেও অনেক বড় বলো?”
–“নিশ্চয় তাই। তবে এই দায় নেওয়ার পেছনে একটা পারিবারিক নীচতা কাজ করেছে শ্রী। সেটাই বলতে চলেছি। তুমি শুনে ভুলে যেও।”
–“এই নিয়ে দু’বার বললে কথাটা।”
–“কথাটা শুনতে ভাল নয়।”
–“বলো। শুনে ভুলে যাব।”
–“শুভাদিদিকে দাদাভাই খুব ভালবাসত। হয়ত দাদা যেমন বোনকে ভালবাসে তেমনই। কিন্তু বাকিদের চোখে ব্যাপারটা ঠিক ওরকম ঠেকেনি। মানে জেঠু বড়মা পর্যন্ত নিজের ছেলেকে অন্যরকম মনে করেছে।”
–“এর পেছনে একটা তো কারণ থাকবে! তোমাদের জয়েন্ট ফ্যামিলি। সেখানে তো তুতো ভাইবোনেদের মধ্যে সহজ সম্পর্ক থাকারই কথা। কেন তবে বাকিদের এমন মনে হল?”
–“শুভাদিদি একটু অদ্ভুত। ছোট থেকে জল ভালবাসে। কারণে অকারণে পুকুরে যায়। গঙ্গাতেও যায়। ওর আবেগগুলো ঠিক স্বাভাবিক নয়। এদিকে এ বাড়ির মেয়ে বলে তার পাড়ায় তেমন মেলামেশা ছিল না। মেয়েদের বাড়ির বাইরে তো এখনও তেমন যেতে দেওয়া হয় না। বাড়ির মেয়ের পড়াশুনো শেষে বিয়ে হবে, এমনটাই সবাই ভেবেছে। স্কুল শেষ হয়ে কলেজে সবে ঢুকেছে, বিয়ের চেষ্টা শুরু হল। মেজজ্যাঠা মেজমা দুজনের চিন্তা ছিল। শিশিরদা ততদিনে শিকলি কেটে উড়ে গেছে। মেয়েকে থিতু করা দরকার। কিন্তু শুভাদিদি কিছুতেই বিয়েতে রাজি নয়। মেজজেঠু মেজমা যত চেষ্টা করেন সব বৃথা। শেষে বাবাকে এসে ধরা হল। শুভাদিদি বাবার খুব প্রিয় ছিল। নিজেকে দিয়েই দেখতে পাচ্ছ একটা মেয়ের জন্য বাবা বুকে কতটা জায়গা রেখেছিলেন। বাবার কাছে শুভাদিদি বিকেলের দিকে আসত। প্রায় রোজ। পরীদের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকত। নিজের মনে নাচত গাইত। বাবা কিছু বলতেন না। সেইরকম একদিন শুভাদিদি এলে বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ‘শুভা তুই বিয়ে করবি না কেন? বিয়েতে ইচ্ছে নেই? নাকি তুই কাউকে পছন্দ করিস? আমাকে বল। আমি কথা বলব। মেজদাকে আমি রাজি করাব।’ শুভাদিদি নাকি দৌড়ে এসে বাবার হাঁটু জড়িয়ে ধরেছিল। বলেছিল, ‘সত্যি আমি যাকে পছন্দ করি তুমি তার সঙ্গেই আমার বিয়ে দেবে?’ বাবা বলেছিলেন, ‘আপ্রাণ চেষ্টা করব, বিশ্বাস কর।’ শুভাদিদি বিশ্বাস করে নামটা বলেছিল। অরুণ রায়চৌধুরী। এ বাড়ির বড় ছেলে। দাদাভাই। বাবার প্রথম হার্টের সমস্যা তখনই শুরু হয়।”
শ্রী চমকে ওঠে। কী বলবে ভেবে পায় না। তবু জিজ্ঞেস করে, “তারপর?” সায়ন ম্লান হাসে।
-“তারপর আর কী? বড়জ্যাঠা বড়মাকে মেজমা বলেছিল, ‘কী হল! মুখ দেখাবো কী করে!’ তাই দাদাভাই শাস্তি মাথা পেতে নিল। এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। কেউ ওর মুখ দেখবে না কোনোদিন। শুভাদিদিকে তো তাড়িয়ে দেওয়া যায় না। ছিছিক্কার পড়ে যাবে। তাই সে কোথাও গেল না। এখানে বসে বসেই শাস্তি ভোগ করছে। আর কী। এই তো কথা। শ্রী ভুলে যেও প্লিজ।”
–“বাবাও কি শুভাদিদিকে খারাপ ভাবে?”
–“নাঃ। বাবা ওকে খুব ভালবাসে। বাবা বলেছিল, সব কিছু মানুষের হাতের মধ্যে থাকে না। অরুণ চলে গিয়ে ভাল করেছে। ওর কাজ মানুষের জন্য। এখানে এত ময়লায় ও কী করবে থেকে?”
রাত ভোর হয়ে এল। বাইরে বস্তির ঘর থেকে শব্দ উঠতে শুরু করেছে। মালি-বউ উমা উঠোনের এক পাশ ঝাঁট দিতে শুরু করে দিয়েছে। শ্রী উঠে পড়ল। মনে মনে ভাবল, ভুলে যেতে হবে। মানুষ যে কেন এমন দুর্ভাগা হয়!
(চলবে)…
(স্নেহময়ের নিজের লেখা কবিতা ছাড়া বাকি কবিতা কবি রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরীর কিছু কবিতা থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে।)




এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান