রাগরঞ্জনী – পর্ব ২ – মিয়া-কি-তোড়ি

(১) 

ফজরের আজানে ঘুম ভাঙল সুর সাধকের। সকালের নামাজ সেরেই আজ যেতে হবে নিজামের দরবারে। মহামতি জালালউদ্দিনের খাসতলব। মনে অজানা আশঙ্কা – কী জানি কী ফরমাশ হবে। এদিকে আবুল ফজল সাহেব কিছুদিন ধরে জানাচ্ছেন যে শাহেনশাহর মন ভার।  

যাইহোক,  চতুর্দোলায় চেপে তানসেন দিল্লির শাহী দরবারে এসে দেখলেন নহবৎখানা শূন্য, কোনও সুর বাজছে না। দেওয়ান-ই-খাস-এর সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি। শাহেনশাহ সোনার মসনদে শরীর এলিয়ে বসে। সৌহার্দ্য বিনিময় সেরে কাছে এলেন তানসেন। সামনেই বসে আছেন ফজল সাহেব ও সভার অন্যান্য পারিষদরা। শাহেনশাহ জিজ্ঞাসা করলেন, “যখন কোন রাগ সৃষ্টি করার চেষ্টা কর অথচ পারো না, তখন কষ্ট হয়?” 

এ কী প্রশ্ন? তিনি তামাম হিন্দুস্থানের শ্রেষ্ঠ কলাবন্ত। তাকে শাহেনশাহ এ কী প্রশ্ন করছেন? মাথা নিচু করে বসে রইলেন তানসেন। আবুল ফজল সাহেব এবার কথা বলার অনুমতি প্রার্থনা করলেন, “মহামতি আকবর সন্তানহীনতার গ্লানিতে ভুগছেন, যোধা এখনো সন্তানের জননী হতে পারেননি …এ ব্যথা তো মননের।”  

এক লহমায় যেন সব মনে পড়ে গেল তানসেনের। দিনের পর দিন নিরলস রেওয়াজের পরও যখন সাধনসিদ্ধি আসত না, মাথার উপর হাত রেখে স্বামী হরিদাস বলতেন, “আরো চেষ্টা কর, আরো মন উজাড় করে সুর লাগাও মকরন্দ। দেখবে রাগ আস্তে আস্তে তার রূপ নেবে, নিরাকার থেকে সাকার হবে।” 

“জি জাহাপনা, কষ্ট হয়, সৃষ্টি না হলে কষ্ট হয়। কিন্তু আমরা তো সৃষ্টির মাধ্যম মাত্র, সৃষ্টিকর্তার উপর আস্থা রাখুন, মুনাজাত করুন, আল্লাহ কৃপাময়। নিশ্চয়ই মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে।”  

‘আমিন’ –  মুখরিত হলো দেওয়ান-ই-খাসএর সকল অলিন্দ। 

(২) 

রাজপুতানার সামন্ত রাজ্যগুলি এখন অনেকটাই স্থিতিশীল। বিদ্রোহ অনেক কমেছে। গুজ্জার প্রদেশ থেকে খবর এলো সেলিম নামে এক দরবেশ এসছেন। তিনি নাকি ধন্বন্তরি। তার আশীর্বাদে অনেক নিষ্ফলা গাছ আজ ফলন্ত। যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন জালালউদ্দিন মোহাম্মদ আকবর। শুরু হল তোড়জোড়। কিন্তু সেই প্রস্তুতির রাজকীয়তায় বাধা দিলেন জালাল। বাবা সেলিমের কাছে যাবেন তিনি পদব্রজে। সাথে নিলেন আবুল ফজল, তানসেন সহ কিছু কাছের মানুষদের।  

স্তেপ ভূমি, আরাবল্লী রুক্ষতার গ্লানি পেরিয়ে, মনে ইষ্ট দর্শনের আকুল আবেগ নিয়ে তাঁরা চলে এলেন বালুকাময় গুর্জর প্রদেশে। পাশের মাজারে চলছে কাওয়ালী। আহা! অতিপরিচিত সুর। হ্যাঁ, তাই তো! এ তো মোহাম্মদ গৌস এর তালিমলব্ধ রাগ, গুজ্জরি তোড়ি। “কুতুব উদ্দিন কুতুব আলম”.. সুরের মূর্ছনায় সকলে বাকরুদ্ধ। তার-ষড়জ থেকে রিখাব, গান্ধারের উদত্ত আহ্বান যেন  ঈশ্বরের কাছে মনের ভক্তির বাঙ্ময়  প্রকাশ। কোমল ঋষভ তার হাহাকার নিয়ে কোমল ধৈবতের মাতৃক্রোড়ে বিলীন হচ্ছে।  

“আহা! অপূর্ব, ধন্য সাধন,” বললেন সুর সম্রাট।  

গান শেষ হলে নিভৃতির যবনিকা ঠেলে বের হলেন পক্ককেশ এক বৃদ্ধ। চোখের তারায় তারুণ্যের ইশারা। গোলাপী গালের হাসিতে প্রাণবন্ত আহ্বান। 

“ফরজন্দ, কাছে এসো।“  

জালালউদ্দিন, যিনি সমগ্র হিন্দুস্থানের মুকুটশীর্ষের পালক, তিনি আজ রিক্ত ফকিরের মতন বাবা সেলিমের সামনে। চোখে জল, আর মনে অপার শ্রদ্ধা। অভিবাদনে, আলিঙ্গনে জানালেন মনের ব্যথা, সন্তানহীনতার গ্লানি।  

(৩) 

আজ ঈদ। খুশির ঈদ। দিল্লির আবালবৃদ্ধবনিতা মনের আনন্দে মঙ্গলগীত গাইছে। সবার সঙ্গে সকালের প্রার্থনা সারলেন মহামতি আকবর। দরবারে আজ জশন। রাবাব, সারেঙ্গী, সেতারের তার বাঁধা হচ্ছে যত্নভরে। তানপুরা পঞ্চম-ষড়জ এর সখ্যতায় মধুর। স্মিত হেসে তানসেন বসলেন জাঁহাপনার রাজদরবারে। চন্দন, অগুরু আর গোলাপের সৌরভে মাতোয়ারা খাসমহল। চিকের আড়ালে হারেমের , বেগম, বাঁদি ও দাসীরা বসেছে। শুরু হল গান। সেই সুর… সেই গুজ্জরি। ঋষভ থেকে ধৈবত-এর দীর্ঘ মিড় যেন সমুদ্রের অতল আহ্বান। আর ধৈবত তাকে যত্ন করে ফিরিয়ে দিচ্ছে তার নিজের জায়গা ঋষভে। স্বর্গীয!  

হঠাৎ ফিরতি পথে ধৈবত নিষাদের সঙ্গতি নিয়ে সুরসম্রাট দাঁড়ালেন পঞ্চমে। দরবারে সবাই হায় হায় করে উঠলো। “সুবহানাল্লাহ!” এ কী অপূর্ব রূপ রাগের! অবরোহণের পঞ্চম গুজ্জরিকে নতুন মালা পরিয়ে দিল – যেন গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো। গান তার ললিত ভঙ্গিমায় সমাপ্ত হল আর ঠিক তখনই শাহী প্রসবাগারের উল্লাসধ্বনিতে মুখরিত হল দেওয়ান-ই-খাস। পুত্রবান হলেন আকবর। চোখে তাঁর জল। দুহাত উপরে তুলে শ্রদ্ধা জানালেন মহান সৃষ্টিকর্তাকে। তানসেন শাহেনশাহর করচুম্বন করে বললেন, “সুরের হাত ধরে আপনার উত্তরসূরি পৃথিবীতে এলো, সেই সুর যা আমরা শুনেছিলাম মাজারের কাওয়ালিতে”। সকল পারিষদকে মোহর তাকসিম করে তানসেনের দিকে এগিয়ে এলেন আকবর। ভরা সভায় নিজের গলার মুক্তামালা কলাবন্তশ্রেষ্ঠকে পরিয়ে দিয়ে বললেন, “হে সুরসম্রাট, তোমার সৃষ্টি মহান। মহান আল্লাহ-র আশীর্বাদ তুমি। বাবা সেলিমের দোয়াতে যে আজ এলো মুঘল সালতনাতের উত্তরসূরি হিসেবে, তার নাম রাখব সেলিম। তোমার সৃষ্ট রাগ তোমার নামেই মহীয়ান হোক, এই রাগের নাম হোক মিয়া-কি-তোড়ি।” 

সম্বুদ্ধ চট্টোপাধ্যায়ের গলায় মিয়া-কি-তোড়ি : https://youtu.be/ZQm11q3Kum4 

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

Blog at WordPress.com.

Up ↑