অনিন্দিতা মণ্ডল
(৮)
দিন চলে যায়। বাড়ি সেরে ওঠে। পরীর গায়ে মার্বেল পরিষ্কার করতে গিয়ে একদিন দেখা যায়, তিনজনের একজন নেই। নেই! থানা পুলিশ হুজ্জুতি সব হলেও চোর ধরা পড়ে না। পুলিশ অফিসার হেসে বলেন, “বাড়ির জিনিস চুরি করে বেচতে লজ্জা করে না আপনাদের? সব জানি। কে কোথায় বেচেছে। আপনারা এফআইআর করুন। পিছ মোড়া করে চোর দাঁড় করিয়ে দেব।”
স্নেহময় বিছানা ছেড়ে যেন আর উঠতে পারেন না। পাশের জ্ঞাতিদের ছেলে বিকাশ আর চন্দন পুলিশের কাছে জানিয়েছে। রাতের অন্ধকারে গোপাল পরী বেচেছে। পল্টু ছিল সঙ্গে। ভ্যানে চড়িয়ে নিয়ে গেছে। গোপাল চালান কেটে দিয়েছে। ঘনশ্যাম হার্ডওয়্যারের ঘনশ্যাম সিং পরী কিনে নিলামে দিয়েছে। কিন্তু বাড়ির ছেলের নামে চুরির অভিযোগে থানায় যাওয়া! ঘটে ওঠেনি। এ কেউ পারে?
গোপাল অপদার্থ। তাই বলে বাড়ির সম্মান বেচবে? কিন্তু গোপালের মায়ের গলার আওয়াজ চড়তে থাকে। নির্লজ্জ সব ছেলেপিলে। বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। ফিরে আসছে। কার আস্কারায় জানি না? চিরটা কাল মুখ বুজে সইলাম। যত নষ্টামি প্রশ্রয় কে দেয়? যে নিজে নষ্ট।
শ্রী ছাদের দিকের দরজা একেবারে বন্ধ রাখে। গলির দিকে আর গঙ্গার দিকের জানলা খুলে রাখে। স্নেহময়কে ইজি চেয়ারে বসিয়ে জলখাবার সামনে রাখে। বলে, “বাবা জানেন, মুন্নির মা নাকি বুধিয়াকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিল। নতুন ডাক্তার আসছে এখন। মনের ডাক্তার। বলেছে, বুধিয়া আগের চেয়ে ভাল হয়ে যাবে। বুধিয়া নাকি ওর বউয়ের কথা ডাক্তারকে বলেছে।”
এমনই সব সাত পাঁচ কথা বলে শ্রী। কখনও ওর প্রিয় কবিতা পড়ে শোনায়। “আচ্ছা বাবা? শক্তি চট্টোপাধ্যায় আপনার কেমন লাগে? ভাল না? জানতাম। আপনার ভালো লাগবেই।”
শীত জাঁকিয়ে পড়েছে। গঙ্গার ওপরে দুধের সরের মতন কুয়াশা জমে ভোরে। ওপারের কিচ্ছু দেখা যায় না। গঙ্গায় সাগরের বিভ্রম জাগে। স্নেহময় সেইদিকে চেয়ে ভাবেন নদী তো সত্যিই সাগর হয়। দেখতে পেলেই হয়।
নতুন সারানো বাড়িতে একদিন আসেন একটি মানুষ। দরাজ গলায় হাঁক দেন, “ছোটকা নেমে এসো। আমি জানি তুমি নামতে পারবে। তোমাকে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আমার।”
সায়ন হাসে। “আসার দিন আর সময়টা একবার জানালে না? এত চমকালে আমাদেরও যে হার্ট নিতে পারবে না! আর কত দায় তুমি নেবে দাদাভাই?” ওপরে ঘরে শুয়ে স্নেহময় সে ডাক শুনতে পান। কেউ যেন তাঁর ধমনীতে তাজা রক্ত ভরে দিয়েছে। হৃৎপিণ্ড সেই অতিরিক্ত অথচ বিশুদ্ধ রক্তের চাপে ছটফট করছে। তিনি সিঁড়ির দিকে চাইলেন। দেবেন দাঁড়িয়ে – “বাবু কাঁধে হাত দিন। আমি ধরছি।”
ছেলেটা না জানিয়েই চলে এসেছে! স্নেহময় সিঁড়ির নীচে এসে দাঁড়িয়েছেন। বুকের মধ্যে শব্দটা জোরালো হচ্ছে। স্নেহময় দেখতে পাচ্ছেন সদরের ধারে বহু মানুষ ভিড় করেছে। আজ আর বাধা নেই। সদর পেরিয়ে ঢুকে আসছে কত মানুষ! গৌরব কারো টাকা দিয়ে কেনা সম্পত্তি নয়! কেউ বলছে, “আরে অরুণদা রে! আমাদের অরুণদা!” কেউ বলছে, “বড় রায়চৌধুরী, ও তুই দেখিসনি। হীরের টুকরো! দ্যাখ না খবরে বলবে।”
শুভা আর শ্রী পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিল। অরুণ এগিয়ে এসে শ্রীয়ের মাথায় হাত রাখেন। শ্রী অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। এই অরুণ রায়চৌধুরী? এ তো বিখ্যাত মানুষ! এই তার ভাশুর? আজ পর্যন্ত কেউ একটা ছবিও তাকে দেখায়নি! কেন? অরুণ তখন বলছেন – “ছোটকা বলেছে বটে সায়নের বউ খুব খুব ভাল মেয়ে। বাড়িটা ওইই দাঁড়িয়ে থেকে সারিয়েছে। কিন্তু সে যে এমন বুদ্ধিমতী তা তো জানতাম না?”
কথা বলতে বলতে অরুণের চোখ থামে – “আর তুই শুভাবুড়ি? সেই এক রকম বোকা রয়ে গেলি? নাকি একটু আধটু বুদ্ধি হয়েছে?” বলতে বলতে শুভার মাথার এলোমেলো খোঁপাটা নেড়ে দেন। চুল খুলে ছড়িয়ে পড়ে। শুভা যেন পাথরে তৈরি প্রতিমা।
দেখতে দেখতে সারা বাড়ির লোক একে একে বেরিয়ে আসে। গোপাল বাদে। এ বাড়িতে আগের প্রজন্মের পুরুষ একমাত্র স্নেহময়। আজ তিনি বীতশোককে নেমন্তন্ন করেছেন। “দেখবে এসো বীতশোক। মানুষ কেমন করে ছিন্নমূল হয়। দেখবে এসো। ঈর্ষা মানুষকে কোন পাতালে টেনে নেয় দেখে যাও। আমাদের বড় ছেলে এতদিন উদ্বাস্তু ছিল। তুমি যে বলেছিলে ওকে ডাকতে, আমি ডেকেছি। ধর্ম দিয়ে ওকে কতদিন সরিয়ে রাখব বলতে পারো? কীসের ধর্ম বীতশোক? ও তো আমার রক্ত! দেখে যাও কেমন ছেলেটা আমার এতকাল ছিন্নমূল হয়ে ঘুরেছে। তুমি শুধু ভাবো পূর্ববাংলার মানুষের চেয়ে হতভাগা আর কেউ নেই। দেখে যাও সব থাকতেও মানুষ কেমন হতভাগ্য হয়।”
বীতশোকের হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন স্নেহময়। স্বাতীর মুখের দিকে চেয়ে বলেন, “ছেলেটাকে ডাকো! ভেতরে এনে বসাও!”
স্নেহময় চেয়ে দেখেন বয়সের ছাপ ফেলা চেহারা নিয়ে এক উজ্জ্বল চোখের তরুণ দুহাত বাড়িয়ে তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে, “ছোটকা!”
শ্রী অবাক বিস্ময়ে দেখছে কী অপার স্নেহ নিয়ে স্নেহময় জড়িয়ে ধরছেন অরুণকে। কত কত কাল যেন চোখের ওপর দিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে। স্মৃতির কাল।
অবশেষে দালানে কোচে এসে বসেন স্নেহময়। পাশে অরুণ।
ভোরের কুয়াশার দিকে চেয়ে চেয়ে অরুণ বলছিল, “জানো ছোটকা, সেখানেও নদীর ওপরে এমন কুয়াশা জমে। এমন করেই নৌকো চলে। আমার ঘর থেকে সেই নদী দেখতে দেখতে আমার বাড়ির কথা মনে পড়ে।”
“তোর দুঃখ হয় না?” জিজ্ঞেস করেন স্নেহময়।
“নাঃ। তোমার হয়?” স্নেহময় হাসেন, “দুঃখ হয় না। তবে ছেড়ে যেতে হবে সেই মায়া মাঝে মাঝে পথ আটকায়।”
এমন করেই দিন শেষ হয়ে আসে। বাড়িতে বিশেষ থাকা হয় না অরুণের। আজ এই সেমিনার কাল ওই আলোচনা সভা। কখনও কলকাতা কখনও দিল্লি বা অন্য শহরে। কিন্তু এখানে এলেই ছেলেমানুষের মতো নতুন সারানো বাড়ির ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়ান।
“বিদেশে এমন বাড়িকে ওরা হেরিটেজ বানিয়ে রাখে রে সায়ন!” সায়ন হাসে – “কিন্তু ঘরগুলো তো আবার ভাঙবে দাদাভাই?”
“না, ভাঙবে না। দ্যাখ না কেমন সলিউশান দিই।”
– “তুমি তো আবার চলে যাবে, আসবে না।” সায়নের গলায় দুঃখ অভিমান ঝরে পড়ে।
– “না না! আসব তো! তুইও যাবি রে। নদীর ধারেই থাকি আমি। শান্ত ছোট্ট নদী। এত বড় নয়। তবে কী জানিস, ওখানে এত মানুষ নেই। মানুষ ছাড়া নদীর কাজ কী বল?”
সায়ন ইতস্তত করে বলে – “তুমি একাই থাকলে দাদাভাই?”
অরুণ মুখ ঘুরিয়ে নেয় – “একা থাকতেই তো বলল রে সবাই।”
– “তোমার বাবার ওপরেও অভিমান, না দাদাভাই?”
অরুণের মুখ বাইরের দিকে। সায়ন পেছনে দাঁড়িয়ে। অরুণের কথা ভেসে আসে – “ছোটকার তখন কিছু বলার ছিল না। ছোট তো!”
অরুণ ফিরে যাবেন বিদেশের কর্মক্ষেত্রে। স্নেহময় নেমে আসেন নীচে। সদর পর্যন্ত সঙ্গে যান। অরুণকে বুকে জড়িয়ে থাকেন অনেক খন। হৃৎপিণ্ড দুটো কি একসঙ্গে লাফাচ্ছে? ছন্দে ছন্দে এত মিল? রমেন্দ্র কী বলবেন শুনলে?
“ছোটকা, আবার আসছি। সবাই ভাল থেকো। সেজমা ছোটমা সব্বাই। গোপাল একবারও এল না। এই সায়ন, পরের বার ওটাকে একেবারে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখিস।”
সেজমা পর্যন্ত অরুণের বুকে হাত রাখেন। মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না প্রথমে। তারপর ভাঙা স্বরে বলেন – “ঘরের ছেলে ঘরে না থাকলে ভাল লাগে রে? কবে আসবি বাবা? দেরি করলে যদি আর দেখতে না পাই?” অরুণ বুকে জড়িয়ে ধরেন – “সেজমা, সেজমা। অন্তর হতে বিদ্বেষ বিষ নাশো! কই বিষ? নেই নেই।” স্বাতীও চিবুক ছুঁয়ে আদর করেন – “একটা হিল্লে করলি না বাবা? এ বাড়িতে যে ঘুঘু চরবে!” অরুণ চোখে হাসেন।
সায়ন ব্যস্ত হয়ে পড়ে নতুন প্রোমোশন পেয়ে। স্নেহময় একটু ভাল আছেন। কীসের একটা প্রতীক্ষা তাঁকে জাগিয়ে রাখে। আবার সপ্তাহান্তিক ভ্রমণে দেলপাড়া যান। কবিবন্ধুর সান্নিধ্যে কাটিয়ে আসেন। জাগরণে বীতশোকের ধারাবাহিক মফস্বলের গণ্ডি ছাড়িয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বৃহত্তর পাঠক গোষ্ঠীর। বস্তি উন্নয়ন সমিতি গড়ে ওঠে। সেই সমিতির হয়ে আবেদন আসে। রায়চৌধুরী বাড়ির একটি অংশে কি নাইট স্কুল করা সম্ভব? স্নেহময় জানান, সম্ভব। শ্রী স্কুল দেখাশুনো করবে। ওর সে শক্তি আছে।
এর মাঝেই শুভা শান্ত হতে থাকে ক্রমে। পুকুরে আগের মতন সারাদিন ভেসে থাকা হয় না। মাছের মতন জলেই নিঃশ্বাস নেওয়া হয় না। পুকুরের পার ভেঙে দীঘি হতে থাকে। সেই দীঘির জলে শান্ত ছায়া পড়ে শুভার, আর রায়চৌধুরী বাড়ির। নতুন সারানো বাড়িতে বস্তির জন্য নাইট স্কুল চালু হয়। কিন্তু এত কিছুর মধ্যে স্বাতীর মন কিছুতেই ভাল থাকে না। ঘরের বউয়ের এত ঢং সহ্য হয় না। আর ধন্যি স্নেহময়! আবার পরিপাটি হয়ে দেলপাড়া যেতে শুরু করেছেন! বাতে পঙ্গু শরীর নিয়ে কাতরাতে থাকেন স্বাতী। তাঁর পায়ে তেল মালিশ করে উমা। সেজদি এসে বসেন। সান্ত্বনা দেন। “তুই আর মন ছোট করিস না ছোট। ছোটবাবুকে কেউ আজ পর্যন্ত বেচাল দেখেনি।” স্বাতী তবু শঙ্কিত থাকেন। সব চাল কি দেখা যায়? কেমন ঘরে শুয়ে শুয়ে চাল দিলেন যে!
(স্নেহময়ের নিজের লেখা কবিতা ছাড়া বাকি কবিতা কবি রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরীর কিছু কবিতা থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে।)
(শেষ)




এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান