অনিন্দিতা মণ্ডল
(২)
শ্রী যখন বিয়ের পর মফস্বলের এই পুরনো পাড়াটায় এল তখন নতুন বউ হিসেবে লজ্জায় মুখ ফুটে বলতে পারেনি যে এরকম জায়গায় থাকতে তার প্রাণ বেরিয়ে যাবে। সে বেশ অনেকদিন আগের কথা। গঙ্গার ধারে ঠিক নয়, তবে কাছেই গঙ্গা। বারান্দা থেকে, ছাদ থেকে, পশ্চিমের জানলা থেকে গঙ্গা দেখা যায়। সেখানে যেতে পারলে হাঁফ ধরা গলিটা তাকে আর কষ্ট দেয় না।
শ্বশুর শাশুড়ি ছাড়াও এবাড়ির কয়েক টুকরোতে আরও কটি প্রাণী বাস করে। প্রকাণ্ড এক বাড়ি, যার তিনটে মহল আছে। ছাতের মাথায় তিনটে পরী আছে। বেশ সুন্দর দেউড়ি আছে। সেই দেউড়ির থামের গায়ে এক বুড়ো বট অসংখ্য ঝুরি নামিয়েছে। দেউড়ি পেরোলেই এককালের সাধের বাগিচা। নিশ্চয় ফুলবাগান ছিল। এখন সেখানে ঝোপঝাড়ে ভর্তি। নয়নতারা আর টগরের ঝোপও আছে। আর আছে লঙ্কা জবা পাতি জবা। তবু ওই দু চারটে ফুল দেখে শ্রীর মন ভরে গিয়েছিল। বেশ তো ফুল!
ভেতরের মহলে কিছুটা মেরামতি করে শরিকেরা বাড়িটা টিকিয়ে রেখেছে। আর একেবারে শেষের মহলের শরিকরা কেউ এদেশে থাকে না। আসেও না। ফলে সেটি জীর্ণ। শুধু একজন সেখানে থাকে। শ্রীয়ের চেয়ে বয়সে হয়ত সামান্য বড়ই হবে। শুভা। তবে সে এক রহস্যময় মহল। আর সেই বাসিন্দাও রহস্যময়ী।
সেই মহলের পেছনে এককালের ফল সব্জির বাগান। নারকেল সুপুরি দিশি খেজুরের মাঝে একটা বড় পুকুর আছে। টলটল করছে জল। কিন্তু বাড়ির আর কেউ সেই পুকুরে যায় না। কী দরকার বাবা? কেউ সরে না পুকুর আর। ও জলে কে নাইবে? স্নান করবার জন্য যেখানে গঙ্গা স্বয়ং বর্তমান সেখানে কে যাবে ওই সাপখোপের আড্ডায় নাইতে? শাশুড়িদের কাছে নিষেধ শুনেছে শ্রী। কিন্তু সে নিজেও তো ভয় পেয়েছে। বাবা! কী নিঝুম পুকুর!
বিয়ের আগে, প্রেমের সময় বোঝা যায়নি। বিয়ের পর টের পেয়েছে। সায়নের কথায় বেশ ঝাঁজ আছে। বিয়ের আগে শ্রী দেখেছে সায়ন বেশ চুপচাপ ধরনের। দেখতেও বেশ নম্র। এমন ছেলে কি এভাবে খোঁচা দিয়ে কথা বলতে পারে? প্রেমের সময় অবশ্য এসব চোখে পড়ে না। শ্রীয়েদের বাড়ি শ্যামবাজারে। খাস কলকাতায়। কলেজে পড়বার সময় এক বন্ধুর বাড়িতে আলাপ হয়েছিল সায়নের সঙ্গে। বন্ধুর কীরকম আত্মীয়। বেশ লেগেছিল সায়নকে। তারপর কী করে যে দুজনে দুজনের প্রেমে পড়ে যায় সেটা আর মনে করতে পারে না শ্রী।
তবুও ও বা সায়ন, দুজনের কেউই ভাবেনি যে এই বাড়িতেই জীবন কাটাবে। এখানে কাজের সুযোগ কই? পড়াশুনো শিখে কাজ করতে গেলে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। সায়নের বাবাদের প্রজন্ম পর্যন্ত কেউ চাকরি করেনি। নিজস্ব ব্যবসা ছিল। তাই চাকরি করবার প্রয়োজন পড়েনি। কিন্তু সায়নের জাঠতুতো দাদাদের দিয়ে চাকরি শুরু। বলা বাহুল্য তারা এ বাড়িতে থাকে না। যে দু’ একজন থাকে তারা দয়া দাক্ষিণ্যে ছোটখাট কাজ যোগাড় করে বাড়িতে থেকে গেছে। প্রথম প্রথম এদের খুব সংকীর্ণ লাগত শ্রীর। সামান্য কিছু নিয়ে বিশ্রী ঝগড়াঝাঁটি। পাঁচিলের বাইরে বস্তির বাসিন্দাদের মতন। তাদের তুচ্ছতা মানা যায়, কিন্তু এদের ক্ষুদ্রতা মানা যায় না। পরে কেমন মায়া জন্মেছে।
বিয়ের পর শ্রী টের পেল। স্বাতী নন। ওদের থাকা না থাকা নির্ভর করছে স্নেহময়ের ওপরে। গম্ভীর অথচ স্নিগ্ধ মানুষটা নিজের কথাটা জানিয়ে দেন। সায়ন যেন স্নেহময়ের ছায়ায় বেঁচে আছে। নিজের অস্তিত্ব বলে যেন কিছুই নেই। শ্রীয়ের পক্ষে বিয়ের আগে এটা বোঝা সম্ভব ছিল না। বুঝতে পেরে ও যে রাগ করবে তা পারেনি। উল্টে নিজেই এই মায়ার পাকে জড়িয়ে গিয়েছে। স্নেহময় শ্রীয়ের সঙ্গে অনেক গল্প করেন। পুরনো দিনের গল্প। তাঁর কলেজের দিন, ইওরোপীয়ান ক্লাবে বিলিয়ার্ড খেলতে যাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে গাড়ি নিয়ে কাশ্মীর পর্যন্ত চলে যাওয়া। ধীরে ধীরে শ্রী বুঝতে পারে, ছাদের ঘরে থাকার কারণে স্নেহময়ের মনের দেওয়ালগুলো ভেঙে গেছে। নীচে নামতে ভালবাসেন না। কিন্তু সায়ন সম্পর্কে তিনি নিজের জায়গায় স্থির। তাকে কোথাও ছাড়বেন না।
সায়ন একটা ভাল সরকারি চাকরি পেয়েছিল ভাগ্যিস। লেখাপড়ায় ভাল ছেলে। বিয়ের পর চাকরি। এই নিয়ে আত্মীয় মহলে ফিসফাস খুব। স্নেহময় উত্তর দিতেন। “একটুও ভাবতে হবে না। এতকাল আমরা চাকরি না করেই বেঁচেছি। ও মরে যাবে না।” ফিসফিসানি নীচ থেকে ওপরে উঠত না। স্নেহময় শ্রীকে ডেকে নিতেন, “একবার ওপরে এসো তো। কাগজের কাজগুলো সেরে দাও।”
আড়ালে গুজগুজ। আর তো কেউ পড়াশুনো জানে না। এই এক বউ এসেছে বাড়িতে। বাপ মা মাথায় বসিয়ে রেখেছে। এই আদরে শ্রী নিজের কথাটা ভুলে গেল। ও যে একদিন স্বাবলম্বী হতে চেয়েছিল, ভুলে গেল। কিংবা হয়ত জোর করে সেকথাটা মনের অন্ধকারে ঠেলে দিল।
বাড়িটা বড় বলেই অন্যান্য বাসিন্দারা যেন বাড়ির মধ্যে থেকেও অনেক দূরে। মাঝে মাঝে দেউড়ি পেরোতে গিয়ে কারো সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। ছোট তরফের কাকাবাবু কিংবা মেজ তরফের ঠাকুমা চলেছেন গঙ্গাস্নানে। এরা অন্য মহল, কিন্তু চলাচলের রাস্তা বাড়ির ভেতর দিয়ে। জ্ঞাতি বলে যে দূরত্ব সেটা বোঝা যায়।
শ্রী যেন কথার অভাবে, শ্যামবাজার হাতিবাগানের হইচই, ট্রাম রাস্তার অভাবে, টাউন স্কুলের সামনের ঘুগনি, সিনেমা হলগুলোর বিকেলের শো, সব কিছুর অভাবে নিজেকে ভীষণভাবে হারিয়ে ফেলছিল। কিন্তু একথা সায়নকে বলা যায় না। “নিজেই তো বিয়ে করে এসেছ। আমি আগেই বলেছিলাম, এ শ্যামবাজার নয়। বলেছিলাম আমাদের বিরাট বড় একটা পোড়ো বাড়ি আছে। বলিনি?” অগত্যা শ্রী কথা হারিয়ে ফ্যালে।
তবু ধীরে ধীরে সে এ পরিবারে জোড়া লেগে গেল। সবচেয়ে বেশি জুড়ে নিলেন শ্বশুরমশাই। ভালবাসার সোচ্চার প্রকাশ নেই। অথচ কেমন মনের মধ্যে ছড়িয়ে যায়। মানুষটা নাকি কম বয়সে কবিতা লিখতেন। শ্রী খুব জেদ করেছিল একদিন। আমাকে কবিতার খাতা দেখতে দিন না! আমি পড়ব। স্নেহময় হেসেছিলেন, “ওসব ছেলেমানুষি। আসল কবিদের সঙ্গ পেয়ে পেয়ে নিজের কবি হবার ইচ্ছে হত তো। হিজিবিজি কাটা ছাড়া কি?” কিন্তু শ্রী দুঃখ পেয়েছে বুঝেছেন। “আচ্ছা, তোমাকে ডায়েরি দেব। যাদের কবিতা আমার খুব প্রিয় সেই সব লেখা আছে। বইও আছে। তবু কতকগুলো লেখা আছে। পড়তে পারো। তা তোমার কবিতা ভাল লাগে নাকি?” শ্রী মাথা নেড়েছে, “সেরকম নয়। ভালবাসি, তবে আপনি কবিতা ভালবাসেন! এটা খুব আশ্চর্য”।”
“কেন? আশ্চর্য কেন? তুমিও তো কমার্স পড়েছ! তাহলে লিটারেচার ভালবাসো যে?” শ্রী চুপ করে দেখছিল। উত্তর দিতে পারেনি। তার চৌহদ্দিতে কবিতা ভালবাসে এমন অভিভাবক সে কখনও দেখেনি। শ্রী কবিতার ডায়েরি থেকে শুরু করে আলমারিতে রাখা সার সার বইয়ে চোখ রেখেছে। স্নেহময়ের সঙ্গে এক অন্য যোগ তৈরি হয়েছে তার।
অনেক ভোরে স্নেহময় তাঁর গুরুর ছবির সামনে খানিকক্ষণ ধ্যান করেন। কিছু গুপ্ত ধর্মাচার আছে তাঁর। ক্রিয়াযোগ। দেহের মধ্যে বায়ুকে স্থির করে প্রাণকে উর্দ্ধমুখী করার সাধনা। এসব একা না হলে হয় না। তাই তাঁর এমন একা থাকা। মধ্যযৌবনে গুরুলাভ হয় তাঁর। গুরুর নির্দেশেই একা থাকা শুরু করেন। স্বাতীর অসুস্থতার শুরুও সেই থেকে। অবিশ্বাস, সন্দেহ, স্নেহময়ের আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বে সন্দিগ্ধ স্বাতী কেমন নিশ্চল হয়ে গেলেন। তাহলে এতদিন যা ভেবেছেন তা মিথ্যে? তাঁর আড়ালে স্নেহময়ের মোহের জগত আছে, তা মিথ্যে? এই যে রমেন্দ্রকুমার, আজীবন কুমার ওই কবি-অধ্যাপক, যার কাছে স্নেহময় যান, বন্ধুত্ব রাখেন, তাঁকেও তো কম সন্দেহ করেননি স্বাতী! চিরকুমার? কক্ষণও নয়! স্নেহময় ভারী গলায় থামিয়ে দিয়েছেন স্বাতীকে। কী বলতে পারতেন? স্বাতীর সঙ্গে মনের মিল তো কোনোদিন হল না! সন্দেহ ছাড়া আর কীই বা পেতে পারেন!
সকালে অনেকটা সময় এভাবে কাটলে তিনি শান্তি পান। তাঁর শান্ত চেহারাটা যেন আরও শান্ত হয়ে থাকে। সে সময় সায়ন খবরের কাগজ নিয়ে বসে তাঁর সামনে। জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী হওয়া হল না, এই নিয়ে সায়ন দুঃখ প্রকাশ করছিল। স্নেহময় তার দিকে চেয়েছিলেন। হঠাৎ বললেন, “প্রধানমন্ত্রী কেমন হলে দেশের ভাল হবে বলে তুমি মনে করো?” সায়ন অবাক, “কেন? আপনি কী মনে করেন? কোয়ালিশন সরকারে জ্যোতি বসু ছাড়া আর চয়েস কোথায়?” স্নেহময় মাথা নাড়লেন, “তা বলছি না। প্রধানমন্ত্রী বলতে তোমার ধারণা কী? কেমন হলে ভাল?” সায়ন বুঝতে পারছিল না। এর কী উত্তর হবে?
স্নেহময় চুপ করে থাকেন। মনে প্রতিধ্বনিত হয়,
“অতীত কাতর কেউ পোশাক বদলে তার/ কষ্টগুলি ভুলে যেতে পারে?” সায়নের জানার কথাও নয়। “দেশপ্রেম যাদের কাছে শিখলাম…বড় চণ্ডীমণ্ডপের কোনে বসে, সেই হাতই আজ, পিছু থেকে এসে, ঘাড় ধরে মুখটি ঘুরিয়ে দিয়ে বলেঃ আমি স্বপ্ন ঘৃণা করি।”
তিনি খবরের কাগজের উলটো পিঠে খেলার পাতায় চোখ রাখেন, মনে মনে নিজের লেখা গুনগুন করেন –
“আজ কি কোনো খেলা হবে? কীরকম খেলা? কাগুজে পাশার চাল দিতে দিতে নিতান্ত কেরানি মনে ভাবে, আমি এক মস্ত তালেবর।”
(চলবে)…
(স্নেহময়ের নিজের লেখা কবিতা ছাড়া বাকি কবিতা কবি রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরীর কিছু কবিতা থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে।)




খুব ভালো লাগছে । পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম ।
LikeLike