সরিতা আহমেদ
অন্ধকার ঘরটায় যখন তার জ্ঞান ফিরল তখন বাইরে গনগনে সূর্যটা আমবাগানের পেছনে ঢলে পড়েছে। তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা দ্রুত কেটে গেল গায়ের উপর দুরন্ত কিছুর সর্পিল চলনে। ধড়মড় করে উঠে বসতেই পায়ে টান পড়ল মোটা শিকলে। এভাবে কতদিন বাঁধা আছে সে – মনে পড়ছে না।
যেন এইমাত্র সে আয়নার সামনে দাঁড়াল,পছন্দসই নেলপালিশ বাছল, হাতে পায়ে লাগানো হেয়ার-রিমুভাল ক্রিম যত্ন করে তুলল, দিদির অজস্র কালেকশান থেকে কানের দুল আর ব্যাকক্লিপের ম্যাচিং নিয়ে তর্ক জুড়ল…
-‘এই হিজড়া বেরো ঘর থেকে।’ এমন চেঁচামিচি জুড়েছিল দিদি যে, মা বেলনা হাতে দৌড়ে এসেছিল। তার গালে সপাটে এসেছিল একটা থাপ্পড়। মাথাটা বোধহয় দেওয়ালে ঠুকে গিয়েছিল।
এইক’টি তাজা স্মৃতি ছাড়া বাকি সব ঝাপসা।
‘কেউ আছ? প্লিজ হেল্প।‘ – কয়েকবার চিৎকার করে ডেকেছে সে। সাড়া মেলে নি। অন্ধকারে চোখ সইয়ে নেওয়ার পরে এটুকু বুঝেছে তার গায়ে স্কুল-ড্রেস আর গোপনাঙ্গে টনটনে ব্যাথা। অজ্ঞান অবস্থায় কীভাবে প্যান্ট ভিজিয়েছে- কিচ্ছু বুঝতে পারছে না সে।
হাতদুটো পিছমোড়া করে বাঁধা। কোনমতে ঘষটে ঘষটে পেছনের দেওয়ালে হাত দিয়ে সে বোঝার চেষ্টা করে এটা কোন জায়গা, তাকে কি শাস্তি দিতেই মা এখানে বন্ধ করে রেখেছে? নাকি কেউ তাকে কিডন্যাপ করেছে! শেষের সম্ভাবনাটা মনে আসতেই প্রচণ্ড ভয়ে সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। কান্নার প্রতিধ্বনি আরও বীভৎস স্বরে প্রতিধ্বনিত হল। এইসময় আরেকবার কিছু একটা পায়ের উপর দিয়ে দৌড়ে যেতেই “বাবা গো” বলে চমকে উঠল সে।
ছোট থেকেই সে বড্ড বাবা-ঘেঁষা। লোকে বলে যে বয়েসে বাচ্চারা আধোবুলিতে ‘মা’ ডাকে – ওই বয়সে সে ‘বা-ব্বা’ ডাকত। বাবা তাকে দিদির চেয়েও বেশী ভালবাসে, আদর করে, অঢেল রং পেন্সিল ও খেলনা কিনে দেয়, মেলায় ঘাড়ে চড়িয়ে ঘুরিয়ে দেখায় ম্যাজিক’শো। তার কাজলরাঙা চোখ, রঙিন নখ দেখে মাঝেমাঝে অবশ্য গম্ভীর হয়ে বলে “এসব কি ঠিক হচ্ছে?” সে দ্রুত আলনায় গুছিয়ে রাখে ঝলমলে স্কার্ট।
-‘সব পাপের একটা প্রায়শ্চিত্ত থাকে। গুরুদেবের কথা মত এ ছেলেরও একটা কিছু ব্যবস্থা কর। নইলে উনি তো বলেইছেন মেয়েটাকে নিয়ে বড় বিপদ হবে। পাড়ায় ছিছিক্কার হচ্ছে –জানো?’
মায়ের ঝংকার থামিয়ে বাবার শান্তস্বর এসেছিল- “হুম।”
বাবার এই শান্ত গলা, সৌম্য ব্যক্তিত্ব তাকে ভরসা দেয় – তাকে কেউ বুঝুক না বুঝুক, বাবা সবটা বোঝে ।
প্যাণ্টের পকেট থেকে তীক্ষ্ণ কিছু উরুতে ফুটছে। চট করে মনে পড়ল ফাদার’স ডের জন্য কেনা নতুন পার্কার পেনের কথা- কাঁচের বাক্সটা বোধহয় ভেঙে গেছে। বাবার মুখটা মনে করে আবারও ডুকরে উঠল সে। বাবা হয়ত তাকে হারিয়ে পাগল হয়ে যাচ্ছে।
সিনেমার মত গুণ্ডারা কত টাকা চাইবে বাবার কাছে? এবার ব্যাবসায় নাকি খুব লোকসান হয়েছে। বাবা কি পারবে টাকা জোগাড় করতে ?
ভাবনার কুয়াশাজাল ফুটো করে দরজায় খুট করে শব্দ হল।
দুটো ছায়ামূর্তি ঘরে ঢুকেছে। সে দমবন্ধ করে দেওয়ালে সেঁটে বসল। তার ছোট্ট বুকে কালিন্দীর পাড়-ভাঙার শব্দ। হঠাত ফস করে একটা টর্চলাইট তার মুখে এসে পড়ল।
-তুমি সাল্টাবে তো? নাকি আমাকেই সবটা করতে হবে?
‘ইঞ্জেকশানটা ধর’
-দেখ,সবটা আমাকে করতে হলে কিন্তু ডাবল চার্জ।
‘কিন্তু কথা তো..’
-চুপ কর! জিম্মি আর খালাসের আলাদা চার্জ। ব্যস!
‘ধুর, প্রব্লেমটা বোঝ – আমার হাতে গ্লাভসটাভস কিছু নেই।’
শেষের কথাটার দমকে টর্চের আলোটাও ঘুরে গেল বেমক্কা।
“বাবা !!” – কোণা থেকে আসা অপ্রত্যাশিত স্বর শুনে দ্বিতীয় ব্যক্তি চমকে উঠে চট করে আলোটা নিভিয়ে দিল। ভূত দেখার মত অবিশ্বাস্য বিস্ময় আর ভয় ছিল গলাটায়।
এক থালা চাঁদের বুকে এখন চাপচাপ মেঘের দল। অন্ধকারটা ফিরে আসছে।




সুন্দর হয়েছে
LikeLiked by 1 person
অনেক ধন্যবাদ
LikeLike
অসাধারণ অণু গল্প! ভীষণ ভাল লেগেছে।
LikeLike
অনেক ধন্যবাদ
LikeLike